রক্তপিপাসু বুরাইদা আসলামীর ইসলাম গ্রহণ

    0
    282
    ইমরান বিন বদরীঃ মক্কার জমিনে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়লে অস্তিত্বহীন হওয়ার ভয়ে কুরাইশরা অংকুরে ধ্বংস করার নিমিত্তে বৈঠকে বসেন। ইতিহাসে যেটি ঘৃণ্য দারুন নদওয়ার বৈঠক বলে স্বীকৃত।
    বৈঠকে মক্কার বিখ্যাত কাফিরগন মানব মুক্তির দিশারি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যাকরার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ঘোষণা দেয় আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ কে হত্যা করলে একশ উট দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে। এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহর নির্দেশ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবী হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে নিয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করে ইয়াস্রিব তথা বর্তমান মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের ইতিহাস মূলত অনেক লম্বা। আজ কেবল হিজরতের পথিমধ্যে রক্তপিপাসু বুরাইদা আসলামী তার দলবল নিয়ে কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছেন সেটাই আলোচনা করবো।
    ◾বুরাইদা আসলামী ছিলেন একজন বীরপুরুষ ও নিজ সম্প্রদায়ের নেতা এবং গোত্রীয় প্রধান। অনেক ঘটনার পরেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার উত্তরে মদিনার দিকে হিজরত করেই চলেছেন। এদিকে কুরাইশদের সেই ঘৃণ্য ঘোষিত পুরস্কারের খবরও ততক্ষণে তখনকার প্রতিটি গোত্রের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। সবখানেই যেন রক্তপিপাসুরা একত্ববাদের ধ্বনিকে নিভিয়ে দিতে ওঁৎপেতে রয়েছে।
    সে ধারাবাহিকতায় এদিকে পুরস্কার হাতছাড়া না করতে মদিনার পথেই আসলাম গোত্রের গোত্রপতি বুরাইদা তার ৭০ জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা নিয়েও প্রস্তুত হয়ে আছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছোট্ট কাফেলা যখন তাদের গোত্রের পাশদিয়ে অতিক্রম করতে লাগলেন তখনই খবর পেয়ে তারা কাফেলার পিছু নিলেন। কি ভয়াবহ নাই ছিলো তাদের অভিপ্রায়! অস্ত্রসজ্জিত দুর্ধর্ষ ৭০ জন লোকের সামনে রাসুলে পাকের ছোট্ট দলটি জাগিতক বিচারে একেবারে-ই নগণ্য।
    কাফেলায় রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছাড়া অপর যে দুজন সাথী রয়েছে তারাও কিন্তু অমুসলিম ছিলেন। মহানবীর নিরস্ত্র কাফেলাটি একপ্রকার রক্তপিপাসু শত্রুর হাতের মুঠোয় অবস্থান করছে। শত্রুদের পিছু নেওয়া দেখে কাফেলার অন্যান্য সদস্যগণ উদ্বেগ আর আশঙ্কায় মুহ্যমান। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম এ নিয়ে মোটেও বিচলিত ছিলেন না। উনার চোখে-মুখেও ভয়ের কোন ভাবান্তরও নেই। তিনি কেবল কিতাবুল্লাহ অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ পাঠ করেই যাচ্ছেন। মহাবিশ্বের রহমতের পবিত্র জবানে কুরআনে কারীমের সুমধুর ধ্বনি চলার পথে যেন ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে।
    পুরস্কারের তাড়নায় বুরাইদা তার অধীনস্থ ৭০ জন খুন পিয়াসিদের নিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে আসছেন ছোট্ট কাফেলার দিকে। আনন্দ আর উত্তেজনায় তাদের খোলা তরবারি সূর্যকিরণে ঝলমল করছে। এ-ই বুঝি রক্তে রঞ্জিত তাণ্ডব চালিয়ে যাবে তারা। এখনই যেন নীল আকাশটি রক্তের লাল চাদের ঢেকে ফেলবে।
    বুরাইদা ও তার দল ক্রমশঃ ছোট্ট কাফেলার নিকটবর্তী হচ্ছেন। তারা যতই নিকটবর্তী হচ্ছে ততই মহানবীর মুখ নিঃসৃত পবিত্র কুরআনের স্বর্গীয় সুর লহরী তাদের কর্ণকুহরে ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিটি শব্দের ধ্বনি তাদের হৃদয়ে প্রশান্তির আঘাতে জর্জরিত করে দিচ্ছে। তাদের কাছে এ উচ্চারিত ধ্বনি অদ্ভুত মোহনীয় লাগছে এবং অশ্রুতপূর্ব আয়াতসমূহের ভাব, ভাষা ও ছন্দে মর্মে মর্মে হৃদয়ে দাগ কাটছে।
    বুরাইদা আসলামীর কাফেলা যতই নিকটবর্তী হচ্ছে, ততই তার পা দুটি কেন যেন অজানা প্রেমে ভারী হয়ে উঠছে। তার বাহু যুগল যেন শিথিল থেকে শিথিলতর হতে চলেছে। লোভাতুর রক্তের সেই তাণ্ডবি নৃত্য যেন তাদের কোথাও হারাতে বসেছে। এভাবেই একসময় বুরাইদা তার দলবল নিয়ে মহানবীর কাফেলার খুব নিকটবর্তী হয়ে গেলো।
    বুরাইদাকে দলবলসহ দেখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত বন্ধ করে তাকে মধুর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
    ‘হে আগন্তুক, কে তুমি , কি চাও আমাদের কাছে?’
    উত্তরে বুরাইদা বলেন,
    ‘আমি আবু বুরাইদা, আসলাম গোত্রের দলপতি’।
    রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
    ‘খুব ভাল কথা।’
    আবু বুরাইদা যেনেও পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
    ‘আপনার পরিচয়টি যদি জানাতেন?’
    রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
    ‘আমি মক্কার অধিবাসী কুরাইশ বংশের আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ, সত্যের সেবক, এবং আল্লাহর রাসুল।
    এখানে একটি কথা বলি, মুলত হত্যাকারী কখনো হত্যা করতে এসে এতো প্রশ্ন করেনা। কিন্তু এখানে যে হৃদয় ঘটিত ব্যপার ! হেদায়েতের দ্বার যে উন্মুক্ত। বুরাইদা মহানবীর সাথে কথোপকথনে যে নিজেকে কখন হারিয়ে ফেলেছে তা অনুভব করার ক্ষমতাও তার নেই। সে আত্মহারা হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কদমে নিজেকে সমর্পণ করে দিলো। এবং তার সঙ্গীরাও রাসুলে পাকের কদমে পড়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে।
    সেদিন মহানবীর কাছে সান্ত্বনার বাণী পেয়ে দলপতি বুরাইদা গিয়ে দাঁড়ালো সে-ই ছোট্ট কাফেলার অগ্রভাগে। সে নিজের মাথার পাগড়ি খুলে বর্শার মাথায় গেঁথে উড্ডীন করেছিল। সেই পাগড়ি যদি পতাকা হয়, তো এটাই বোধহয় ইসলামের সর্বপ্রথম পতাকা। ইসলামী লেখক ও গবেষক- ইমরান বিন বদরী,মাদ্রিদ স্পেন।