মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গলের বাইক্কাবিলে পাখি শুমারি অনুষ্ঠিত

    0
    716

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২৯জানুয়ারী,জহিরুল ইসলাম: মৌলভীবাজারে শ্রীমঙ্গলের বাইক্কাবিলে দুই দিনব্যাপী পাখি শুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর বাইক্কাবিলে ৩৮ প্রজাতির পরিযায়ী ও দেশীয় জলচর পাখির দেখা মিলেছে। তার মধ্যে রয়েছে ১৬ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আর ২২ প্রজাতির স্থানীয় দেশীয় জলচর পাখি। বিগত ২০০৪ সালে বাইক্কাবিল প্রতিষ্ঠার পর ওই বছরের জুলাই মাস থেকে পাখিশুমারির আওতায় নিয়ে আসা হয়। ওই বছরে মোট ২৯৬ টি জলচর পাখি বাইক্কাবিলে আসে।জলাভুমির সূচক অনুযায়ী শুধুমাত্র জলচর পাখিকেই এ গণনার আওতায় অর্ন্তভুক্ত করা হয়।

    ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইকোসিস্টেমস অ্যান্ড লাইভলিহুডস (ক্রেল) রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর মাজহারুল ইসলাম ইসলাম জাহাঙ্গীর বলেন, ক্রেল এর সিনিয়র কো-ম্যানেজমেন্ট এডভাইজার পল থম্পসন এ বছর ২২-২৩ জানুয়ারী দুইদিন ব্যাপী শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের বাইক্কাবিলে পাখি গণনা করেন।

    এ বছর বাইক্কাবিল অভয়াশ্রমে পরিযায়ী ও দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মোট ৮ হাজার ৮৩২টি জলচর পাখি গণনা করা হয়েছে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে পাখি শুমারিতে ৬ হাজার ৯৯১টি জলচর পাখি এই শীত মওসুমে বাইক্কা বিলে অবস্থান করে। বাইক্কা বিলে পাখিশুমারির তথ্যে জানা যায়, ২০০৫ সালে বাইক্কবিলে মোট ১ হাজার ১৭৪টি জলচর পাখি আসে, ২০০৬ সালে আসে ৬ হাজার ৯৪৯টি, ২০০৭ সালে ৭ হাজার ২০৪টি, ২০০৮ সালে ৬ হাজার ৪২৯টি, ২০০৯ সালে ৯ হাজার ৪০৫টি, ২০১০ সালে ১২ হাজার ২৫০টি, ২০১১ সালে ৫ হাজার ৯৮৯টি, ২০১২ সালে ৩ হাজার ৯৬৪টি, ২০১৩ সালে ৭ হাজার ৪৯৯টি, ২০১৪ সালে ১০ হাজার ৪৭৯টি পরিযায়ী ও দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির জলচরপাখি বাইক্কাবিলে আসে।বাইক্কাবিলে গত ১৩ বছরের পাখি শুমারিতে পাখি বছরে বছরে দেশীয় ও পরিযায়ী জলচর পাখি কম বেশীর কারণ জানতে চাইলে পল থম্পসন বলেন, বাইক্কাবিল অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার পর সেখানে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করা হয়।

    এর মধ্যে যেমন হিজল করচের বাগান,গাছ লাগানো,খনন কাজ করা হয়। এ কাজ গুলো সাধারণত শুকনা সিজনে করা হয়। যখন পাখি আসা শুরু হয়। তখনই কাজ শুরুর কারণে পাখি আসা কমে যায়। আবার কাজ শেষের পর পাখি আসা শুরু করে। তিনি বলেন,পরিযায়ী পাখিরা আসার পূর্বে তাদেও আবাসস্থলটি নিরাপদ কি না সিটি বিবেচনায় রাখে।সাধারণত যখন পাখিরা আসে তখন জলাভুমিতে মাছ ধরা পড়ে। মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। তাই শিকারের ভয়ে অর্থাৎ পাখিরা যখন বুঝে নেয় তাদের আবাসস্থলটি নিরাপদ নয়, তখনই পরবর্তী বছরে পাখির আনাগোনা কমতে থাকে। এছাড়া পরিযায়ী পাখি যখন যেখান থেকে তারা আসে সেখানে প্রজনন অবস্থা কি রকম ছিল বা যে পথে আসা যাওয়া করে সেই পথের সার্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে।

    এমনকি বাইক্কাবিলের বাহ্যিক অবস্থা যে পরিমাণে গভীরতা,জলজ উদ্ভিদের পরিমাণ,প্রাচুর্য্য এসবের উপর নির্ভর করে। যেমন বিভিন্ন প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের আবাসস্থল পছন্দ করে। তাদের খাবার ভিন্ন ভিন্ন। এসব কারণেই পাখি বছরে বছরে কম বেশী হয়। পল থম্পসন বলেন,এ বছর বাইক্কবিলে বালি হাঁসের সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। দেশীয় পাখিদের মধ্যে এ বছর বাইক্কবিলে ২০০ বালিহাঁসের দেখা মিলেছে।আর খয়রা কাস্তে চরা নামের পরিযায়ী জলচর পাখিটি আজ থেকে ৪/৫ বছর আগে বাংলাদেশে দেখা মেলেনি। এটি এখন প্রতি বছর এর সংখ্যা বাড়ছে। এবছর বাইক্কাবিলে ৮৬ টি পাখির দেখা মেলে।তিলা লালসা পাখির দেখা মেলে ৬৬৪ টি। বাইক্কাবিলে এ পাখিটির সংখ্যা এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশী এসেছে।জঁভভ(গেওয়ালা বাটান) পাখিটি ১ হাজার ৮৮ টির দেখা মেলেছে।

    এ পাখিটির সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। এশিয়ান ওয়াটার বার্ড সেনসাস সাউথ এশিয়া এর আওতায় এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ভলোন্টিয়ারগন প্রতিবছরের জানুয়ারি মাসের মধ্য দুই সপ্তাহের মধ্যে এ পাখি শুমারী করা হয়। বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় এ শুমারী হয়। এ মধ্যে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওর, কুলাউড়ার হাকালুকি হাওর, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, উপকূলীয় অঞ্চলের নিঝুম দ্বীপ, উপকূলীয় দ্বীপ, সোনাদিয়া, সন্দ্বীপ সহ অনেকগুলো স্থানে একযুগে এ পাখিশুমারী অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের বাইক্কা বিল, হাকালুকি হাইল হাওর, সোনাদিয়া, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ক্রেল প্রকল্পের অর্থায়নে এই পাখি শুমারী করা হয়।এই পাখি শুমারীটি বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্যদের দ্বারা করা হয়ে থাকে এবং এই ক্লাব সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।

    পল থম্পসন জানান, সোমবার ও মঙ্গলবার এ দুইদিন মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে, একই সময়ে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখি শুমারী অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে পাখি শুমারী শেষ হয়ে গেছে। তিনি জানান, আন্তর্জাতিকভাবে ওয়েটল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল এই পাখি শুমারীর সমন্বয় করে আসছে। বাংলাদেশে এটি পাখি শুমারীর ৩০তম বছর আর এশিয়াতে পাখি শুমারীর বছর ৫০তম। পল থম্পসন আরো বলেন, ক্রেল প্রজেক্টের মাধ্যমে বিগত ১০ বছর যাবত হাইল হাওরের পার্শ্ববর্তী প্লাবন ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে বিভিন্ন মৎস্য খামার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এর ফলে প্লাবন ভূমি অর্থাৎ উন্মুক্ত জলাভূমির ব্যাপ্তি সংকুচিত হয়ে আসছে। ফলশ্রুতিতে মাছের বিচরণ ক্ষেত্রের ফাশাপাশি হাওর এলাকায় প্রজনন ক্ষেত্রও হারিয়ে যাচ্ছে।

    এমনকি দেশীয় প্রজাতির মাছকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। স্থানীয় দারিদ্র জনসাধারণ তাদের জীবন জীবিকার জন্য বিভিন্ন ধরণের সম্পদ আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে কিছু সংখ্যক বিত্তশালী লোক তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। পল থম্পসন বলেন, যদি সরকার এবং স্থানীয় জনসাধারণ একসাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেন, তাহলেই কেবল প্রাকৃতিক সম্পদেও সংরক্ষণ করা সম্ভব। যার ফলশ্রুতিতে হাওরের সুন্দর পরিবেশ, বন প্রাণীর সংখ্যা, মাছ, সর্বেপরী জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে। এবং স্থানীয় জনসাধারণের উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি চিত্ত বিনোদনের পথকে আরো সুগম করবে। পাখিগুলো আসে কোথা থেকে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুদূর সাইবেরিয়া, চায়না, মধ্য এশিয়া, ইন্ডিয়া ও আসাম থেকে। আর কিছু হলো হলো স্থানীয় দেশীয় প্রজাতীর পাখি বাইক্কা বিলে আসে।

    বিশেষ করে শীতের সময়ই পরিযায়ী পাখি বাইক্কা বিলে আসে। এবারই প্রথম বাইক্কা বিলের পাশে গড়ে তুলা সাবেক এমপি শফিকুর রহমানের জলাশয়ে পাখি শুমারী অনুষ্ঠিত হয়। এ জলাশয়ে মোট ১ হাজার ৭ শত ১৪ টি পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে।অপর এক প্রশ্নের জবাবে পল থম্পসন বলেন, আসলে বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার পরে এটি সংরক্ষণে সফলতার দাবীদার স্থানীয় জনসাধারণ, সমাজভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন, বাংলাদেশ সরকার এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগ। যারা বাইক্কা বিলের কৃতিত্বের দাবীদার।

    তাছাড়া ইউএসআইডি’র অর্থায়নে মাচ্ প্রকল্প তারপর আইপ্যাক এবং বর্তমানে ক্রেল এর মাধ্যমে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিএনআরএস এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।