মৌলভীবাজারের বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল গরিবের বন্ধু

    0
    381

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২৩মে,বিক্রমজিত বর্ধন,নিজস্ব প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের রাজনগরের নিশিকান্ত দাশ। জন্ম থেকে  দু-চোখ অন্ধ। রাস্তাঘাটে গান গেয়ে ভিক্ষা ভিত্তি করে কোন রকমে তার দৈনন্দিন খোড়াক মেটাতেন। নিশির পরিবার তাকে তাদের বোঝা মনে করতেন। অন্ধ নিশির গানের খবর পায় বিএনসবি চক্ষু হাসপাতাল কর্তপক্ষ। এর পর নিশির খোঁজে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লোক লাগান।

    এক সময় বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল খোজে পায় নিশিকে। নিয়ে আসেন মাতারকাপনস্থ তাদের এই হাসপাতালে। হাসপাতালের ডাক্তাররা গভীর যতœসহকারে নিশির দু’চোখ অপারেশন করেন। আর অপারেশনের পর জন্মান্ধ নিশি দুনিয়ার আলো দেখে আনন্দে আত্মহারা। আর নিশির চোখের আলো ফিরিয়ে দিয়ে বিএনএসবি হাসপাতালের সাধারণ সম্পাদক, ডাক্তার স্টাফদেরও আনন্দের শেষ নেই। আর এই আনন্দে বিএনএসবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিশির পরিবর্তী জীবনের পথ পর্দশক হিসেবে তাকে বিএনএসবিতেই চাকুরী দেন। বর্তমানে নিশি চাকুরী করছে বিএনএসবির একটি অঙ্গ প্রতিষ্টান নবীগঞ্জ চক্ষু হাসপাতালে।

    এভাবে মৌলভীবাজারের মাতারকাপন বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল এতদ অঞ্চলের বাতিঘর হিসেবে কাজ করছে। দৃষ্টি হারিয়ে যারা কর্মক্ষম তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়ে কর্মপযোগী করে দিচ্ছে এ হাসপাতালটি।  ঘুছেছে তাদের বেকারত্ব ও অন্যের উপর ভর করে চলা। যা অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও তরান্বিত করেছে।  আর এই কারনে প্রতিষ্টানটি এখন সিলেট বিভাগের বাতিঘর হিসেবে খ্যাত হয়েছে। তিল তিল করে স্বমহিমায় প্রতিষ্টানটি অতিক্রম করেছে ৩৫টি বছর।

    ১৯৮৩ সালে ৩.২১ একর জমির উপর বিদেশী দুটি সংস্থার অর্থায়নে গড়ে উঠে এই হাসপাতালটি। এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৫ সালে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্টার পর থেকেই সিলেট বিভাগের ৪টি জেলা ছাড়াও ব্রাম্মনবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ জেলার রোগীরা এই হাসপাতালে এসে তাদের চোখের সেবা নিয়ে থাকেন। আর যত দিন অতিবাহিত হয় ততই এর পরিধিও বাড়ে, বাড়ে এর রোগীর সংখ্যা। বর্তমানে বছরে এর সেবা নেওয়া রোগীর সংখ্যা দুই লক্ষের উপরে। যার মধ্যে অধিকাংশ রোগীই চোখে ছানি পড়া নিয়ে আসেন। যাদের ৭০ ভাগই রোগীকেই বিনামুল্যে চোখে ল্যান্স সংযুক্ত করে দেয়া হয় বলে জানালেন, প্রতিষ্ঠানটির অবৈতনীক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোসাহিদ আহমেদ চুন্নু।

    তিনি জানান, তারা শুধু এই হাসপাতালে নয়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দূরবর্তী বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে প্রত্যেক মাসেই আই ক্যাম্প করে সরজমিনে চক্ষু সেবা দিয়ে থাকেন। সেখানে ছানি পড়া রোগী পেলে তাদের বিএনএসবি- তে এনে চোখ অপারেশন করে ভালো করে দেন।

    শুধু বয়স্ক নয় সম্প্রতি শিশুবান্ধব করে বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালে চালু করা হয়েছে শিশু ওয়ার্ড। সেখানেও প্রতিদিন দুইশ‘র উপরে  শিশু রোগীকে তাদের চোখের সেবা দেয়া হচ্ছে। আর বৃহত্তর সিলেট বিভাগে শিশুদের জন্য এটাই একমাত্র শিশুবান্ধব চক্ষু হাসপাতাল। যেখানে অনেক ক্ষেত্রে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে শিশু রোগীকে পাঠানো হয়।

    আর এখানে রোগীদের সেবা দেয়া হয়ে থাকে পরম ¯েœহে এবং ভালোবাসায়। যারা চিকিৎসা নেন তাদের কাছের আত্মীয়ের মতো অত্যন্ত যতœ করেন হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অনান্য সংশ্লিষ্টরা। এখানে একজন রোগী বিনামুল্যে চিকিৎসা নিলেও রোগীকে এবং তার সাথের একজনকে দুপুরের খাবার রাতের খাবার ও সকালের নাস্তা ফ্রি দেয়া হয়। আর একজন রোগীকে চিকিৎসা দিয়েই তাদের দ্বায়িত্ব শেষ করেনা। তারা প্রতি রোগীকেই ফলোআপ করেন। অপারেশন করা রোগীকে অপারেশনের এক সাপ্তাহ পর এবং তারও এক মাস পর পর্যন্ত রোগীকে পর্যবেক্ষনে রেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া হয়।

    এ হাসপাতালে চক্ষু ডাক্তার আছেন ১২ জন। আর সব মিলিয়ে স্টাপ আছেন ১২৮জন। এর বাহিরে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোসাহিদ আহমদ চুন্নু ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে এম এ মুনিম বেতন ছড়া  প্রতিদিনই অফিস করেন।

    প্রতিষ্ঠানটি বিদেশী সংগঠন আন্দেরী হিলপি ও ওরবিস এবং বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ফান্ডের অর্থায়নে পরিচালিত হলেও এর বিশাল ব্যায়ভারের জন্য বৃত্তবানদেরও এগিয়ে আসার আহবান জানান এর পরিচালনা পরিষদ। তাদের এ আহবানে সারা দিয়ে সম্প্রতি ডাচ্ বাংলা ব্যাংক বেশ কিছু চোখে ছানি পড়া রোগীর দ্বায়িত্ব নিয়ে রোগী প্রতি ৩ হাজার টাকা করে প্রদান করছেন। এর ফলে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন চা বাগানের বেশ কিছু অন্ধরোগী ফিরে পাচ্ছে তাদের চোখের আলো।

    সাধারণ সম্পাদক জানান, প্রতিষ্টানটির বাৎসরিক ব্যায় হয় প্রায় ৬ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। এই বিশাল ব্যায় নির্বাহনের জন্য আরো সাহায্য প্রয়োজন। তিনি বৃত্তবানদের কাছে আহবান রাখেন তাদের যাকাত ফান্ডসহ সাধ্যমতো সহায়তা করে প্রতিষ্টানটিকে টিকিয়ে রাখার।

    এদিকে এখানে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আর্থিক ভাবে লাভবানের চেয়ে  মানষিক তৃপ্তিই হচ্ছে বড় বলে জানান, এ প্রতিষ্ঠানের কনসালটেন্ট ডা: আলামিন। তিনি জানান, এখানে রোগী আসেন অন্ধ হয়ে আর ফিরে যান দৃষ্টি নিয়ে। সুস্থ হয়ে রোগী যখন মনের আনন্দে তাদের জড়িয়ে ধরেন তখন মনে হয় যেন এটাই স্বর্গের সূখ। তিনি জানান, রোগী অনেক সময় বাপ বলে ডাকে। যা মনের মধ্যে অন্যরকম এক তৃপ্তি এনে দেয়। তিনি জানান, এখানে চাকুরী করায় এলাকার মানুষ মুল্যায়নও করেন বেশ। যে কারনে তিনি নিজেকে গর্বিত মনে করেন।

    আর প্রতিষ্ঠানের অপর কনাসালটেন্ট ডা: আমিনুল জানান, এ হাসপাতালটি সিলেট বিভাগের অন্যতম চক্ষু হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসার মান অনেক ভালো। এখানে রয়েছে গ্লুকুমা ডিপার্টমেন্ট। যদি কোন কারনে রোগীর চোখের পেশার বেড়ে যায় তাহলে এই ডিপার্টমেন্ট থেকে তা সারানো হয়। তিনি জানান, কাছা কাছি সময়ে এখানে সংযুক্ত হচ্ছে রেটিনা ভিট্রোরেটিনা ডিপার্টমেন্ট । এ বিভাগে চিকিৎসার জন্য রোগীকে ঢাকায় যেতে হয়। কিন্তু সিলেট বিভাগের গরিব রোগীর পক্ষে ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হয় না, যা তারা সরাসরি এখান থেকেই এ চিকিৎসা নিতে পারবেন।

    বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মো: এহসানুল মান্নান মামুন জানান, এই হাসপাতালটি বিগত তিন দশক ধরে সিলেট বিভাগের প্রতন্ত অঞ্চলের দরিদ্র রোগীদের বিনামুল্যে সেবা প্রদান করে আসছে। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা যখন সুস্থ হয়ে ফিরে যান তখন রোগীদের আনন্দ ও চোখের ভাষা চিকিৎসা সেবায় সম্পৃক্তদের আবেগাফ্লুত করে। যা দেখে তিনিও মনের মধ্যে অন্যরকম এক প্রশান্তি অনুভব করেন। তিনি বলেন, এ প্রতিষ্টানে চাকুরী করায় তিনি মানুষকে সেবা করার সুযোগ পাচ্ছেন। এটাই তার জীবনের একটি বড় পাওয়া।

    এ প্রতিষ্টানে গরিব কোন রোগীর কাছ থেকেই টাকা নেয়া হয় না। যাদের টাকা দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে শুধু তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তা গরিবের জন্য ব্যয় করা হয়। তিনি জানান, এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্টান। এখানে শুধু চক্ষু চিকিৎসা দিয়েই প্রতিষ্টানটি ক্ষান্ত থাকছেনা। এখান থেকে বিভিন্ন প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরহিত ও জনপ্রতিনিধিদের এনে চোখের প্রাথমিক পরিচর্যার বিষয়ে প্রশিক্ষন দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্কুলে গিয়ে ছাত্রছাত্রিদের এ বিষয়ে ধারণা দেয়া হয়। একই সাথে তাদের চোখ পরীক্ষা করে যাদের দৃষ্টি ত্রুটি পাওয়া যায় তাদের চশমা ও ঔষধ প্রদানসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

    এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের অপটমেট্রিষ্ট আব্দুল বাতেন বলেন, হাসপাতালটির পরিচ্ছনতা যে কারো নজর কারে। এর পরিচন্নতা রোগীর মনের মধ্যে বেশ প্রভাব ফেলে। পুরো হাসপাতালটি সব সময় ঝকঝকে করে রাখা হয়। বেশ কয়েকজন পরিচ্ছন্নকর্মী দিনে অনেকবার তা পরিষ্কার করেন। তাছাড়া কোন রোগীর সাথে ডাক্তার থেকে শুরু করে কোন স্টাপই বিরক্তির সুরে কথা বলেন না। তাদের আন্তরিক আচরণ রোগীকে মুহিত করেন।

    কথা হয় এ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়া নিশিকান্ত দাশের সাথে। নিশি জানান, এই প্রতিষ্ঠানটি তার কাছে ভগবানের মতো। তিনি কোনদিন ভাবেননি পৃথিবীর আলো দেখতে পাবেন আর চাকুরী করার স্বপ্ন দেখার তো প্রশ্নই উঠেনা। বিএনএসবি কর্তৃপক্ষ তাকে খোঁজে এনে চোখ অপারেশন করে ভালো করেছেন এবং তাদের প্রতিষ্ঠানেই তাকে চাকুরী দিয়েছেন। এখন তার চাকুরীর বেতন দিয়েই নিশির সংসার চলে।

    আর ওরবিস ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক সদ্য প্রতিষ্টিত শিশু বিভাগটি প্রতিষ্টার পর সিলেট বিভাগের প্রত্যন্ত এলাকার শিশুরা এখান থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে।  শিশু বিভাগটি সাজানো হয়েছে সম্পন্ন শিশু বান্ধব করে। শিশু বিভাগে রাখা হয়েছে শিশুদের বিভিন্ন রাইডসও। যা শিশুদের বিনোদনের খোড়াক যোগায়। এ ব্যাপারে শিশু চক্ষু চিকিৎসক ডা: সাজেদা খানম জানান, এই বিভাগ চালু হওয়ার পর এখান থেকে বহু শিশুর চোখের ছানি অপারেশন করা  হয়েছে। বিশেষ করে বহু শিশুর টেরা চোখ ভালো করা হয়েছে।

    প্রতিদিনিই এখান থেকে প্রায় অর্ধশত রোগী অপারেশনের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। আর তারা পরনির্ভরতার গ্লানি মুছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়ে পরিবারের আর্থিক উন্নয়নে ভুমিকা রাখছেন।