মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় ওসি প্রদীপের ফোনালাপ ফাঁস

    0
    267

    সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার ঘটনার পরদিন সকালে ওসি প্রদীপ দাস অজ্ঞাত এক ব্যক্তিকে ফোন করে মামলা থেকে বাঁচার পথ খোঁজেন। এ সময় ওসি প্রদীপ তার থেকে নানা পরামর্শ নেন,কীভাবে বাঁচবেন এই ঘটনা থেকে। ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সময় তার কন্ঠে সেনাবাহিনীকে নিয়ে ছিল ভয় ও উদ্বেগ।

    এমনই একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে গণমাধ্যমে। ফোনালাপে প্রদীপের কন্ঠের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলেও অজ্ঞাত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এদিকে শনিবার (৮ আগস্ট) বিমানবন্দরে র‌্যাব সদর দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট যে ফোনালাপ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা র‌্যাবের নজরে এসেছে। এ ফোনালাপের বিষয়টি আমরা যাচাই-বাছাই করছি। এছাড়া অন্য বিষয়গুলো বিস্তরভাবে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

    ঘটনার পরদিন সকালে ওসি প্রদীপ দাসের সঙ্গে অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির ফোনালাপটি
    পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো—

    পরামর্শদাতা: হ্যালো-

    ওসি প্রদীপ: স্যার আদাব স্যার

    পরামর্শদাতা: হ্যাঁ

    ওসি প্রদীপ: স্যার আমি ওসি টেকনাফ প্রদীপ, স্যার

    পরামর্শদাতা: হ্যা কি খবর প্রদীপ কোরবানির গরুর মধ্যে কি ?

    ওসি প্রদীপ: স্যার একটা মহাবিপদে পড়ছি, আপনার সাহায্য দরকার

    পরামর্শদাতা: বলো বলো

    ওসি প্রদীপ: এখন আমরা স্যার একটা ১৫৩, ১৮৬ ও ৩০৭ এ মামলা নিছি স্যার

    পরামর্শদাতা: ওয়ান ফিফটি থ্রি

    ওসি প্রদীপ: স্যার থ্রি ফিফটি থ্রি

    পরামর্শদাতা: থ্রি ফিফটি থ্রি সরকারি কর্মচারি আরেকটা হচ্ছে

    ওসি প্রদীপ: আরেকটা হচ্ছে ১৮৬ পুলিশের কাজে বাধা

    পরামর্শদাতা: আর্মিদেরকে ইন্টিমেশন দিছ কিনা?

    ওসি প্রদীপ: এরপরে স্যার জানাইছি, আর্মি থেকে লোকজন আসছে

    পরামর্শদাতা: এ কি আর্মির নাকি?

    ওসি প্রদীপ: স্যার অবসরপ্রাপ্ত

    পরামর্শদাতা: ও তাইলে এতো ডরের কি আছে?

    ওসি প্রদীপ: এখন স্যার ও মারা গেছে, ইনজিওরড অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছে

    পরামর্শদাতা: এর সঙ্গে যে লোকটা ছিল ওইটা কি?

    ওসি প্রদীপ: ওইটা স্যার একটা ছাত্র, ইউনিভার্সিটির। সে বলছে যে তারা রাতের বেলা পাহাড়ের সিন নেয়ার জন্য আসছে।

    ওসি প্রদীপ: ওরা নাকি ইউটিউবের একটা চ্যানেল করার জন্য আসছে ভ্রমণের উপরে।

    পরামর্শদাতা: গাড়িওয়ালারে এরেস্ট করছ কিনা?

    ওসি প্রদীপ: স্যার গাড়িচালক তো ও নিজেই

    পরামর্শদাতা: ও আচ্ছা আচ্ছা, গাড়ি জব্দ করছ কিনা?

    ওসি প্রদীপ: জি স্যার করছি

    পরামর্শদাতা: আচ্ছা তোমরা যে বাধা দিছ, ওভারটেক করে গেছেক, এটার সাক্ষী আছে কিনা?

    ওসি প্রদীপ: সাক্ষী আছে স্যার

    পরামর্শদাতা: সাক্ষী থাকলে মামলা নিতে বলো

    ওসি প্রদীপ: মামলা নিছি স্যার ১৮৬, ৩৫৩, ৩০৭

    পরামর্শদাতা: প্রেয়ার দিয়া দিবা যে মার্ডার হইয়া গেছে

    ওসি প্রদীপ: আরেকটা কেস দিতে হবে না স্যার?

    পরামর্শদাতা: আরেকটা কেস নিবা?

    ওসি প্রদীপ: আরেকটা কেস আমরা কি নিবো?

    ওসি প্রদীপ: ও যে সদর হাসপাতালে মারা গেছে তাদের একটা কেস নিয়ে নিবো স্যার?

    পরামর্শদাতা: আমার তো মনে হয় সদর থানার একটা কেস নিলে ভালো হয়

    ওসি প্রদীপ: ভালো হবে না স্যার?

    পরামর্শদাতা: আমার মনে হয় ভালো হয়। আর্মির লোক তো পরে টানাটানি করে কিনা!

    ওসি প্রদীপ: নাহলে তো স্যার ওরা স্যার লাশ নিয়ে গেলে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে।

    ওসি প্রদীপ: আমরা একটা মামলা করে ফেললে ওই মামলাটা ট্যাগ করা যাবে।

    পরামর্শদাতা: তাহলে তোমরা একটা কাজ করো না, ৩০৪ এও একটা মামলা নিয়া নিতে পারো।

    ওসি প্রদীপ: ৩০৪ এ আমরা কি লিখবো স্যার?

    পরামর্শদাতা: লেখবা যে হাউএভার মারা গেছিলো। এ কারণে মামলা করা হলো। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হোক।

    ওসি প্রদীপ: স্যার ৩০৭ এ আসামির কলামে কি লিখবো?

    পরামর্শদাতা: না আরেকটা সেপারেট মামলার জন্য বলছি। যেহেতু মারা গেছে তাই এ মামলা করা হলো

    ওসি প্রদীপ: স্যার মামলা নিবো যে আসামির কলামে নাম লিখতে হবে না?

    পরামর্শদাতা: পুলিশে গুলি করছিলো, বুজছি তো। এই এজাহারটা পুরা লিখবা, যে এই এই কারণে তাকে অবস্ট্রাকশন করে আটকানো হইছিলো। আটকানো হওয়ার পরে এই মামলা রজু হইছে। হাসপাতালে পাঠানোর পরে সেখানে সে মারা গেছে। যেহেতু মানুষ মারা গেছে তাই তদন্ত সাপেক্ষে মামলা রজু করা হলো, ৩০৪ এ

    ওসি প্রদীপ: আসামি অজ্ঞাত

    পরামর্শদাতা: এইটা করলে কোটে এইটা ট্যাগ হয়ে যাবে

    ওসি প্রদীপ: স্যার ৩০৪ আমরা নিবো নাকি সেখানে ডিউটি থেকে নিয়ে নিবো?

    পরামর্শদাতা: সদর থানায় হইবো নাকি মামলা?

    ওসি প্রদীপ: সবকিছু লেখার পরে লেখবো যে মারা গেছে স্যার

    পরামর্শদাতা: তোমার এজাহারটা হুবহু লেইখা যাইবা, যে এই এই মামলার আসামিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। যেহেতু মারা গেছে মামলা রজু করা হলো। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হোক

    ওসি প্রদীপ: সবকিছু লিখে লাস্টে এটা লিখবো

    পরামর্শদাতা: যেহেতু মারা গেছে মামলা রজু করা হলো। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হোক।

    প্রসঙ্গত, দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া সিনহা মো. রাশেদ খান লেটস গো নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। আরো তিন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি উঠেছিলেন নীলিমা রিসোর্টে। গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন।

    ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের কথা জানিয়ে সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে। এই ঘটনায় পুলিশ মামলাও করে। তবে পুলিশের এই ভাষ্য নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতিনিধি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

    এদিকে সিনহাকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে বুধবার কক্সবাজারের আদালতে মোট ৯ পুলিশকে আসামি করে মামলা করেন তার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। আদালতের নির্দেশে বুধবার রাতেই মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত হয়। এই হত্যা মামলায় বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে ১ নম্বর এবং টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলেন- এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এএসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা।

    মামলার পর ওইদিন বিকালে টেকনাফ থানা থেকে ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে প্রত্যাহার করা হয়। পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ২০ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে পাঠানো হয় দুদিন আগেই। এ মামলায় বৃহস্পতিবার টেকনাফ থানা থেকে প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, শামলাপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতসহ ৭ আসামির প্রত্যেককে র‌্যাব হেফাজতে সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই সঙ্গে পলাতক ২ আসামি এএসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফাকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

    এজাহারে সিনহার বোন অভিযোগ করেন, ওসি প্রদীপের ফোনে পাওয়া নির্দেশে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই লিয়াকত আলী গুলি করেছিলেন সিনহাকে। এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় ইচ্ছাকৃত নরহত্যা, ২০১ ধারায় আলামত নষ্ট ও মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরি এবং ৩৪ ধারায় পরস্পর সাধারণ অভিপ্রায়ে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০২ ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে (২১) মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে। ঘটনার দিনই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, মাদক ও অস্ত্র আইনের মামলায় তাকেও আসামি করা হয়।

    সিনহা নিহতের ঘটনায় জড়িত সব পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে বুধবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের সমিতি রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া)। একই দিন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ কক্সবাজারে গিয়ে সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, এই ঘটনায় যে এই ঘটনায় দায়ী হিসেবে যে বা যারা চিহ্নিত হবে, তারাই শাস্তি পাবে। এর দায় বাহিনীর উপর পড়বে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সিনহার মা নাসিমা আখতারকে ফোন করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দেন।