শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক কেন ?

    0
    229

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,১ফেব্রুয়ারী ম আহমদ : বিশ্বের নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং খ্যাতিমান গণহত্যা বিষয়ক গবেষকদের প্রতিবেদন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় রয়েছে যেখানে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ বা বিতর্ক করা প্রকান্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করার সামিল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
    মীমাংসিত এই বিষয় নিয়ে নেতিবাচক এই মন্তব্য বন্ধে সামাজিক ও সরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মত দিয়েছেন গবেষকরা। ১৯৭২ এর ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে পৌঁছান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। সেখানেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদের ব্যাপারে প্রথম কথা বলেন তিনি। পরে দেশে ফিরে রেসকোর্সে দেয়া ভাষণে জানান শহী“ের কথা।
    জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসর্কোস ময়দানের ভাষণে বলেন, ৩০ লাখ লোককে মেরে ফেলা হয়েছে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মহাযুদ্ধেও এত নাগরিক মৃত্যুবরণ করে নাই। পরে ৭১ এর ১৬ ই ডিসেম্বর এম আর আক্তার মুকুলের চরম পত্রে পাওয়া যায় ৩০ লাখ শহীদের উল্লেখ। পূর্বদেশ, মরনিং নিউজ, অবজারভার ও দৈনিক বাংলা পত্রিকায়ও মেলে এর সমর্থন। ৭২ এর ৩ জানুয়ারি ৩০ লাখ শহীদের কথা জানায় সোভিয়েত পত্রিকার প্রাভদা।
    গবেষক নিউ কুপার তার এক বইয়ে ৩০ লাখ শহীদদের সংখ্যা উল্লেখ করে নানা বিশ্লেষণ দিয়েছেন। স্টাটিসটিকস অব ডেমোসাইড বইয়ে লামেল বলেছেন, ৭১’এ শহীদ হয়েছেন ৩০ লাখ ৩ হাজার মানুষ। তার গবেষণায় অঞ্চল ভিত্তিক তালিকা করে নারী পুরুষ হিন্দু মুসলমানের পরিসংখ্যান দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে বিষয়টি।
    পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া সামান্তা পাওয়ারের বইয়ে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিষয়টি পেয়েছে সমর্থন। এসবের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক যুক্তির জন্য নেয়া যায় জনসংখ্যার সমর্থনও। এতে বলা হয়েছে বড় ধরনের গণহত্যার প্রভাব পড়বে জনসংখ্যার হিসেবেও।্ জাতিসংঘের বাংলাদেশের জনসংখ্যা পরিসংখ্যান বলছে ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এতেও পাওয়া যায় ৩০ লাখ শহীদের সমর্থন।
    ১৯৮১ সালে ইউএন হিউম্যান রাইটস ডিকলারেশন বলছে, মানবতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালে রয়েছে সবচেয়ে বড় েেরকর্ড। সবচেয়ে অল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ হত্যার নজির। প্রতিদিনে গড়ে হত্যা করা হয়েছে ৬ থেকে ১২ হাজার মানুষ। এ হিসেবে শহীদের সংখ্যা ৩১ লাখ ২০ হাজার।
    এছাড়া গ্রিস বুক অব এনসাইক্লোপিডিপয়ায় উল্লেখ আছে এ সংখ্যার। এত তথ্য ও উপাত্ত থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা বিতর্কিত মন্তব্য করা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনার পরিপন্থি উল্লেখ করে এসব মন্তব্য বন্ধ করার দাবি জানান নানা সংগঠন ও শহীদের স্বজনরা।
    এ বিষয়ে প্রবীণ সাংবাদিক কাজী সিরাজ বলেন, রাষ্ট্রপতি বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তার একটি লেখায় বলেছেন বাংলাদেশে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ।এই মুহুর্তে বিএন পি সেই অবস্থান পরিবর্তন করছে কেন ?
    তিনি বলেন, শহীদের সংখ্যা নিয়ে যে প্রশ্নটি তারা তুলেছে এটা আসলে দুর্ভাগ্যজনক। খালেদা জিয়া নিজেও তো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী ছিলেন। তার রেকর্ড খুঁজে দেখেন এরকম নজির আরও পাওয়া যাবে। তিনি নিজেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের কথা উল্লেখ করেছেন। এটা বলার প্রেক্ষাপট আমি বুঝতে পারলাম না। তিনি কিন্তু তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং দুইবার বিরোধী দলীয় নেত্রী ছিলেন। তখন কিন্তু তিনি এ কথা তুলেননি। তখন চাইলে তিনি সংসদেই এটা আলোচনা করতে পাতেন। এতদিন পরে তিনি এটা তুললেন কেন তা জনগণ নিশ্চয়ই এটা খুঁজে পেতে চাইবে। এমন একটা সময়ে তিনি এ কথাটা তুললেন। তিনি এই বক্তব্য দিয়েছেন ২১শে ডিসেম্বর তার ঠিক এক দেড় ম্াস আগেই বাংলাদেশে বড় দুজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তার একজন তার দলের নেতা। আর একজন জামাতের সাধারন সম্পাদক যাকে তিনি তার দলের নেতার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতেন। যখন দায়িত্ব বন্টন করেন তখন একটি এলাকায় দুজন নেতা ছিলেন। বিএনপির নজরুল ইসলাম খান আর জামায়াতের আলী আহসান মুজাহিদ। দায়িত্ব বন্টনের সময় দলের নেতারা বলেন, ওই এলাকায় আমাদের নজরুল ইসলাম সাহেব আছেন তিনি ওখানে দায়িত্ব পালন করবেন। তখন নাকি খালেদা জিয়া বলেন, কেন আমাদের মুজাহিদ আছে না। অর্থাৎ নিজের দলের নেতার চাইতেও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত নেতা হিসেবে তার সমর্থন তার দলে থাকার জন্য তিনি বেশি জরুরি মনে করেছিলেন। এই জিনিস থেকে ওই দুইজন আর একজন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, দলের তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নন ভূইয়া থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা ছিলেন, সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও বিএনপি নেতা মীর শওকত আলী বেঁচে ছিলেন, উইন কমান্ডার হাবিবুল্লা, সেক্টর কমান্ডার একজন তারা বেঁচে ছিলেন এবং এখনও আছেন। এরপরে অনেকেই আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন তারা সবাই সালাউদ্দিনের বিরোধীতা করেছিলেন যাতে তাকে কমিটি মেম্বর করা না হয়। তাকে বিএনপি থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের সম্পর্কে কটূক্তি করার জন্যে। সেই সালাউদ্দিকে তিনি স্থায়ী কমিটির সদস্য করেন যে সালাউদ্দিন চৌধুরী মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে যখন ফাঁসি হয়ে যায় তখন পাকিস্তান মাত্রা ছাড়া রিএ্যাকশন দেখান। তারা ৭১ এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করেছে। এদেশে কোন যুদ্ধ হয়নি। বাংলাদেশে মানবতা বিরোধী কোন অপরাধ ঘটেনি। মানবতা বিরোধী কোন অপরাধী নেই।
    তিনি বলেন, আলী আহসান মুজাহিদ চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশে মানবতা বিরোধী কোন অপরাধ ঘটেনি। মানবতা বিরোধী কোন অপরাধী নেই। তারা পাকিস্তানের অনুসারি এবং তারা আমাদের লোক। মুক্তিযুদ্ধকে তারা অস্বীকার করেছে, আবমাননা করেছে এবং অস্বীকার করেছে তাদের সব অপকর্মের। ঠিক ওই সময়ে খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য দেয়াই হল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে পাকিস্তানের অবমূল্যায়ন তিনি তার পরিপূরক হয়েছেন। ওই বক্তব্যে সমর্থন সূচক বক্তব্য তিনি ২১ শে ডিসেম্বর দিলেন। সারা পৃথিবীতে যে যুদ্ধ হয়েছে তাতেও কিন্তু এমন হচ্ছেনা। তাদের সংখ্যা নিরুপণ করা যাচ্ছে। ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা হিটলারের নাৎসি বাহিনী করেছিল বলে মিত্র বাহিনী অভিযোগ করেছিল। তখন নয়া নেত্রীবৃন্দরা বলেন, হিটলার এটা করেন নি। সেই প্রেক্ষাপটে এই সিন্ধান্ত হয়েছিল যে যারা এসব করেছে তাদের বিচার হওয়া দরকার। ঠিক আমাদের দেশে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তার জন্য তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক। এগুলো বলার অর্থ হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে গৌরব তাকে ছোট করে দেয়া।
    সাম্প্রতিক যে বিতর্কটি চলছে এ বিতর্কটিকে আপনি আসলে কিভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী সিরাজ বলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক। আসলে কে কি বলল তাতে আমাদের ইতিহাস নষ্ট হয়ে যাবে না। ইতিহাস তার নিজের গতিই চলবে। কিছু মৌলবাদীদের ভোট আছে যাদের ভোটগুলো পাওয়া জন্য বেগম জিয়া এসব বক্তব্য দিয়েছেন।
    গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন তরুণ লেখক ও গবেষক আরিফ রহমান। তিনি বলেন, সত্য কথা বলতে আমরা যে নতুন করে গবেষণা করছি তাতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের আগে ্এবং পরের জনসংখ্যার হারটা দেখলে বুঝা যাবে প্রায় ৪০ লাখের মত মানুষের একটা গ্যাপ রয়ে গেছে। কিন্তু এখন যে বিতর্কটা শুরু হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে তালিকা করার দাবি। পৃথিবীর অনেক দেশে যুদ্ধ হয়েছে কিন্তু যারা সুনির্দিষ্ট জাতি গোষ্ঠী না তাদের কখনও মৃতব্যক্তির তালিকা করা যায় না। তখন লাশ গুম করা হয়েছে আপনি তাকে কি করে পাবেন। এখন যদি বলেন, যারা গুলি খেয়ে মারা গেছে তারাই শহীদ সেটা হাস্যকর হবে।
    হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ড. রিজার্ভ ক্যাশ বলেন, বাংলাদেশে যে যুদ্ধ হয়েছে তার কোন তালিকা হয় না। অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসক ড. জি এস সি ব্যারিস বলেন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যে ৬ লাখ বীরাঙ্গনা ছিল। এর ১ লাখ বীরাঙ্গনা মুক্তিযুদ্ধের পরে আত্মহত্যা করেছে। কলেরায় মারা গেছে ৫ লক্ষ শিশু, তাদের কোথায় রাখব। সুতরাং তালিকা করার কথাটা একেবারে অযৌক্তিক। যে তালিকা দরকার তা আমাদের আছে।
    এই বিতর্কটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফ রহমান বলেন, এটা পলিটিক্যাল বিতর্ক। বঙ্গবন্ধু দেশে আসার আগেই চরম পত্রে ৩০ লাখ লোকের কথা প্রকাশ পায়। পূর্বদেশ পত্রিকায় ৩০ লাখের কথা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জানতেন না যে দেশে স্বাধীন হয়েছে তার আগে সারা পৃথিবীর মানুষ জেনে গেছে।
    ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি থেকে নেয়া।