মিয়ানমারে ব্যাপক গুলি ও হেলিকপ্টারে বোমা নিক্ষেপ

    0
    325

    আমার সিলেট টুয়েন্টি ফোর ডটকম,২৭আগস্ট,ডেস্ক নিউজঃ   মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের তিনটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত শহর মংডু, রাথিডং ও বুচিডংয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তের উখিয়া ও ঘুমধুম ঢেকুবনিয়া এলাকায় গতকাল শনিবার বিকেল ৪টা থেকে আবারও ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী।
    এদিকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও রাখাইন নির্যাতন থেকে বাঁচতে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এবং নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা। অনেকেই মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশে ঢুকবে বলে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এসব শহর ও আশপাশের এলাকায় শুরু হওয়া সংঘর্ষ এখনো চলমান রয়েছে বলে জানান শুক্রবার গভীর রাতে নাফনদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা জাহিদ হোসেন (২২)। জাহিদ মিয়ানমারের মংডু থানার ধনখালী গ্রামের দিল মোহাম্মদের ছেলে। মিয়ানমারে বোমার আঘাতে জাহিদের শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
    মিয়ানমার বাহিনীর বোমা হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে জাহিদ পূর্বকোণকে বলেন, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আমাদের বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। তখন আমরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম। পরিবারের অন্যান্য চার সদস্য কোথায় আছে জানি না। আমি শুক্রবার রাতে টেকনাফের নাফ নদী হয়ে শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে ট্রলার নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। এসময় ঐ ট্রলারে ছিল বোমার আঘাতে ক্ষত–বিক্ষত আরও ২৭ জন রোহিঙ্গা। তারা সবাই বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। তবে কে কোথায় গেছে কোথায় অবস্থান করছে জানি না। হয়ত অনেকেই হ্নীলার লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকতে পারে। কারণ ওখানে অনেক স্বজন রয়েছে।
    জাহিদের সাথে পালিয়ে আসা বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত আরেকজন মোহাম্মদ সাদেক (২০)। তিনি একই এলাকার মৃত মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর ছেলে। আহত সাদেক জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে হেলিকপ্টার থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। সে বোমার আঘাতেই ক্ষতবিক্ষত হন সাদেক। গুরুতর সাদেক পালিয়ে আসেন নাফ নদীর কিনারায়। তারপর একটি ট্রলারে এরকম নির্যাতনের শিকার আরও ২৭ জনের সাথে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।
    টেকনাফের হ্নীলা অনিবন্ধিত লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি–ব্লকের ১২০ নং বাসার বাসিন্দা ও আহত জাহিদের ভাগিনা মোহাম্মদ হোসাইন জানান, শুক্রবার রাতে খবর পেয়েছিলাম বৃহস্পতিবার মিয়ানমার বাহিনীর বোমার আঘাতে মামা জাহিদ গুরুতর আহত হয়েছেন। এরপর শুক্রবার গভীর রাতে মামা শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে আসেন। শনিবার সকাল ১১টার দিকে আমি মামাকে প্রথমে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের এনজিও সংস্থার একটি হসপিটালে ভর্তি করি। ওখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এরপর বিকালের দিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে আসি। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার শাহীন মো. আবদুর রহমান জানিয়েছেন, শনিবার সন্ধ্যার দিকে জাহেদ ও সাদেককে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাদের শরীরের প্রায় ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তারা মিয়ানমার থেকে বোমায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে পালিয়ে এসেছেন বলে জানান। বর্তমানে তারা হাসপাতালের ৫ম তলায় ভর্তি রয়েছেন।
    এদিকে বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তের উখিয়া ও ঘুমধুম ঢেকুবনিয়া এলাকায় গতকাল শনিবার বিকেল ৪টার থেকে প্রচ– গুলিবর্ষণে পুরো এলাকায় চরম আতঙ্ক ও উৎকন্ঠা বিরাজ করছে। মিয়ানমারের আইন–শৃংখলাবাহিনীর অতর্কিত গুলিবর্ষণে উখিয়ার সীমান্ত এলাকা বালুখালী, ঘুমধুম, তুমব্রু, ঢেকুবনিয়া এলাকা ও সীমান্তের জনপদ জুড়ে সাধারণ লোকজনের মাঝে উদ্বেগ ও অজানা আতংক দেখা দিয়েছে।
    কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন গতকাল শনিবার সকাল ১০টায় উখিয়া উপজেলা পরিষদ হলরুমে এক জরুরি সভায় প্রশাসনসহ আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর সকলকে কড়া সতর্ক অবস্থায় থেকে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
    এছাড়া মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য জড়ো হওয়া লোকদের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। আহতদের মধ্যে দু’জন বাংলাদেশে মৃত্যুবরণ করেছে। শনিবার ভোরে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হাফেজ হারুন (৩৫) নামের গুলিবিদ্ধ এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তিনি মিয়ামারের মংডু ফকিরা পাড়ার শামশুল আলমের ছেলে। তাছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মংডু এলাকার মুসা নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
    শুক্রবার রাত থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, কোস্টগার্ড ও নৌ বাহিনীর বরাত দিয়ে মাইকিং করে সাগরে মাছ ধরার ট্রলারসমূহ না যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে বলে মাইকে এমন প্রচারণা চালানো হয়। এই তথ্য নিশ্চিত করে সেন্টমার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ জানান, শুক্রবার রাতে সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে মিয়ানমারের মেরুল্লা ও হাইসসুরাতা এলাকায় ব্যাপক আগুনের লেলিহান শিখা দেখা গেছে। বঙ্গোপসাগরে দেখা গেছে মিয়ানমার নৌ–বাহিনীর ৩টি জাহাজ। এ কারণে কোনো মাছ ধরা নৌকাকে পরবর্তী নিদের্শ না দেওয়া পর্যন্ত সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ ও পুর্বে না যেতে বলা হয়েছে।
    স্থানীয় বাসিন্দা আবুল মঞ্জুর হেলালী জানান– বালুখালী, ঘুমধুম তুমব্রু বেতবনিয়া এলাকার বাসিন্দারা মিয়ানমারের সীমান্ত বাহিনীর মুহূর্মুহূ প্রচ– গুলিবর্ষণের ঘটনায় সীমান্ত আতংকিত হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় নিচ্ছে। বালুখালী গ্রামের মেম্বার নুরুল আবছার চৌধুরী বলেন, শনিবার বিকালে মিয়ানমারের বাহিনী একের পর এক গুলিবর্ষণ শুরু করলে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রাণের ভয়ে নিরাপদ আশ্রয় নিচ্ছে। ওপারের গুলিতে এপারে আতংক দেখা দিয়েছে বেশি।
    কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান জানান, সীমান্তের যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য মোতায়েন ও টহল জোরদার করা হয়েছে।
    এদিকে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে মুসলিম রোহিঙ্গারা। রাতের আঁধারে বিভিন্ন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দলে দলে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে তারা। বিজিবির কড়া নজরদারির মাঝেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
    গতকাল শনিবার ভোরে উখিয়ার বালুখালী, পালংখালী, উলুবনিয়া ও টেকনাফের হোয়াইক্যং, লম্ববিল, উনছিপ্রাং, ঝিমংখালী, খারাংখালী, হ্নীলার পুলের ডেইল, রঙ্গীখালী ও চৌধুরী পাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। শুক্রবার বিকেলে নাফ নদী পাড়ি দেওয়া প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা নারী–পুরুষকে বিজিবি ঠেকাতে পারলেও রাতের বেলা তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।
    গতকাল শনিবার ভোরের আলো ফোটার পর থেকে ওই এলাকায় তাদের আর দেখা যায়নি। হোয়াইক্যং এর সিএনজি ট্যাক্সিচালক নুর মোহাম্মদ জানান, গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত সিএনজি, মাহিন্দ্রা ও টমটম যোগে দলে দলে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছে।
    এদিকে লেদা শরণার্থী ক্যাম্পের বস্তি কমিটির নেতা আনোয়ার হোসেন জানান, মিয়ানমারের হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে ইতোমধ্যে ৬ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। তারা টেকনাফের নয়াপাড়া, লেদা, উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পেগুলোতে অবস্থান করছে বলেও জানান তিনি ।
    উল্লেখ্য, মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ৮৯ জনের মৃত্যু ঘটে। এর মধ্যে ৭৭ জন রোহিঙ্গা মুসলিম এবং বাকি ১২জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর রোহিঙ্গা যোদ্ধারা পুলিশ পোস্টে হামলা এবং একটি সেনাঘাঁটিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করলে এ সংঘর্ষ বাঁধে বলে জানা যায়। এরপর শুক্রবার মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে পড়ে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।সুত্রঃপুর্বকোন।