মহানবীর প্রচলিত পবিত্র বংশধারা কতোটা সঠিক?

    0
    414

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,৩০মার্চঃ মহানবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সাল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে হযরত আদম (’আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত প্রচলিত পবিত্র নসবনামাটি (বংশলতিকা/বংশধারা) কতোটা সঠিক, তা এখানে যাচাই করে দেখবো:

    ঐ নসবনামার তিনটি ধাপ রয়েছে। যথা-

    প্রথম ধাপ: নবীজী (’আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম) থেকে আদনান পর্যন্ত।

    দ্বিতীয় ধাপ: আদনান থেকে হযরত ইব্রাহীম (’আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত।

    তৃতীয় ধাপ: হযরত ইব্রাহীম থেকে হযরত হযরত আদম (’আলাইহিমাস সালাম) পর্যন্ত।

    প্রথম ধাপ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। সীরাতে ইবনে হিশাম (০১), তাবাকাতে খলীফা (০২), তাবাকাতে ইবনে সা’দ (০৩), বুখারী শরীফ (শিরোনাম হিসেবে), তারীখে তাবারী (০৪), আর-রাওদ্বুল উনুফ (০৫) ইত্যাদি প্রাচীন ও নির্ভরযোগ্য কিতাবে নবীজী থেকে আদনান পর্যন্ত প্রায় অভিন্ন নসবনামা রয়েছে। এতে তাঁকে আদনানের ২১শ (একবিংশ) বংশধর এবং কুরাইশ বংশের হাশেমী খানদান হিসেবেই দেখানো হয়েছে। যেমন-

    মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (আসল নাম শায়বা) ইবনে হাশিম (আসল নাম আমর) ইবনে আবদে মান্নাফ (আসল নাম মুগীরা) ইবনে কুশাই (আসল নাম ঝাইদ) ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবনে কা’ব ইবনে লূয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর (আসল নাম বা উপাধি কুরাইশ) ইবনে মালিক ইবনে নাদ্বর ইবনে কিনানা ইবনে খুঝাইমা ইবনে মুদরিকা (আসল নাম আমির) ইবনে ইলইয়াস ইবনে মুদ্বার ইবনে নিঝার (বা নাঝার) ইবনে মা’দ ইবনে আদনান।

    দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে বেশ মতভেদ রয়েছে। এ নসবনামাটি কোনো হাদীছ শরীফে পাইনি। কেউ পেলে, তা জানিয়ে বাধিত করবেন। তবে তা ইতিহাস ও জীবনীতে বেশ গরমিল পেয়েছি। যেমন-

    ইবনে হিশামের বর্ণনায় এভাবে আছে: আদনান ইবনে উদ্দ (বা উদাদ) ইবনে মুকাওয়াম ইবনে নাহুর ইবনে তায়বা ইবনে ইয়ারুব ইবনে ইয়াশজুব ইবনে নাবিত ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইব্রাহীম।

    ইবনে সা’দ ও তাবারীর বর্ণনায় এভাবে আছে: আদনান ইবনে উদাদ ইবনে আল-হামায়সা ইবনে সালামান ইবনে আওস ইবনে বুঝ ইবনে কামওয়াল ইবনে উবায় ইবনে আওয়াম ইবনে নাশিদ ইবনে হাঝা ইবনে বলিদাস ইবনে তাদলাফ (বা ইয়াদলাফ) ইবনে তারিখ ইবনে জাহিম ইবনে নাহিশ (বা তাহিশ) ইবনে মাখী ইবনে ’আবাকী (বা ’আয়ফী) ইবনে ’আবকার ইবনে উবায়দ ইবনে আদ-দুয়া ইবনে হামাদান ইবনে সানবার ইবনে ইয়াছরাবী (বা ইয়াছরিবী) ইবনে নাহঝান (বা ইয়াহঝান) ইবনে ইয়ালহান ইবনে ইর’আওয়া ইবনে ’আয়ফায় (বা আয়ফা) ইবনে দীশান ইবনে ঈসার ইবনে আকনাদ ইবনে আবহাম (বা আয়হাম) ইবনে মুকসী (বা মুকসির) ইবনে নাহিছ (বা নাহিদ) ইবনে ঝারিহ ইবনে শাম্মী ইবনে মাঝঝী ইবনে ’আওস (বা আওস) ইবনে ’আররাম (বা আররাম) ইবনে কীঝার ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইব্রাহীম।

    লক্ষ্যণীয় যে, ইবনে হিশামের বর্ণনায় আদনানকে হযরত ইব্রাহীমের ৯ম এবং ইবনে সা’দ ও তাবারীর বর্ণনায় ৪১শ (একচত্বারিংশ) বংশধর হিসেবে দেখানো হয়েছে! তবে ৩টি সূত্রই বলছে যে, আদনান হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈলের (’আলাইহিমাস সলাতু ওয়াস সালাম) বংশধর।

    তৃতীয় ধাপ নিয়ে একটু মতভেদ রয়েছে। এ নসবনামাটিও কোনো হাদীছ শরীফে পাইনি। তাই, কেউ পেলে, তা জানিয়ে কৃতজ্ঞতাভাজন হবেন। তবে তা বাইবেল, ইতিহাস ও জীবনীতে একটু ব্যতিক্রম পেয়েছি। যথা-

    বাইবেলের পুরাতন নিয়মের আদিপুস্তকের হিব্রু সংস্করণে এভাবে আছে: ইব্রাহীম ইবনে তেরহ ইবনে নাহোর ইবনে স্বরূগ ইবনে রিউ ইবনে পেলেগ ইবনে এবর ইবনে শেলহ ইবনে অর্ফক্ষদ ইবনে শেম ইবনে নোহ ইবনে লেমক ইবনে মথূশেলহ ইবনে হনোক ইবনে যের্দ ইবনে মহল্লেল ইবনে কৈনন ইবনে ইনোশ ইবনে শেথ ইবনে আদম।

    আর এর গ্রীক ও শমরীয় সংস্করণ এবং নতুন নিয়মে লুকের বর্ণনায় এভাবে আছে: ইব্রাহীম ইবনে তেরহ ইবনে নাহোর ইবনে স্বরূগ ইবনে রিউ ইবনে পেলেগ ইবনে এবর ইবনে শেলহ ইবনে কৈনন ইবনে অর্ফক্ষদ ইবনে শেম ইবনে নোহ ইবনে লেমক ইবনে মথূশেলহ ইবনে হনোক ইবনে যের্দ ইবনে মহল্লেল ইবনে কৈনন ইবনে ইনোশ ইবনে শেথ ইবনে আদম।

    ইবনে হিশামের বর্ণনায় এভাবে আছে: ইব্রাহীম ইবনে তারেহ বা আঝার ইবনে নাহূর ইবনে সারূগ বা আসরাগ ইবনে রাউ বা আরগু ইবনে ফালিখ ইবনে আয়বার বা আবির ইবনে শালিখ ইবনে আর্ফাখশাঝ ইবনে সাম ইবনে নূহ ইবনে লামাক ইবনে মাত্তু শালাখ ইবনে আখনুখ বা আখনুক (অনেকের মতে, ইনি ইদ্রিস নবী) ইবনে ইয়ার্দ ইবনে মাহলীল বা মাহলাঈল ইবনে কায়নান বা কায়িন ইবনে ইয়ানিশ বা আনূশ ইবনে শীছ ইবনে আদম।

    ইবনে সা’দের বর্ণনায় এভাবে আছে: ইব্রাহীম ইবনে আঝার ইবনে তারাহ ইবনে নাহূর ইবনে সারুগ ইবনে আরগু ইবনে বালিগ (ফালিজ) ইবনে আবির ইবনে শালিখ ইবনে আর্ফাখশাদ ইবনে সাম ইবনে নূহ ইবনে লামাক ইবনে মুতাওয়াশশালিখ ইবনে খানূখ ইবনে ইয়ার্দ্ব ইবনে মাহলাঈল ইবনে কায়নান ইবনে আনূশ ইবনে শীছ ইবনে আদম।

    তাবারীর বর্ণনায় এভাবে আছে: ইব্রাহীম ইবনে তারাহ (আঝার) ইবনে নাহূর ইবনে সারু’ ইবনে আরগু ইবনে ফালিগ ইবনে ’আবির ইবনে শালিখ ইবনে আফাখশাদ ইবনে সাম ইবনে নূহ ইবনে লামাক ইবনে মুতাওয়াশশালিখ ইবনে খানূখ ইবনে ইয়ার্দ্ ইবনে মাহলাঈল ইবনে কায়নান ইবনে আনূশ ইবনে শীছ ইবনে আদম।

    লক্ষণীয় যে, বাইবেলের হিব্রু সংস্করণ, ইবনে হিশাম ও তাবারীর বর্ণনায় হযরত ইব্রাহীমকে হযরত আদমের ঊনবিংশ এবং বাইবেলের গ্রীক ও শমরীয় সংস্করণ, লুক ও ইবনে সা’দের বর্ণনায় বিংশ বংশধর হিসেবে দেখানো হয়েছে! আর আঝারের নাম বাইবেলে নেই; কিন্তু কুরআনে (৬:৭৪) আছে – যাঁকে ইবনে হিশাম ও তাবারীর বর্ণানায় তারাহ’র অপর নাম এবং ইবনে সা’দের বর্ণানায় তাঁর ছেলে হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাই, তিনি কি হযরত ইব্রাহীমের বাবা, নাকি চাচা, নাকি তারাহ’র অপর নাম – এ নিয়ে মতভদ হয়েছে। তবে এ ৫টি সূত্রই বলছে যে, হযরত ইব্রাহীম – হযরত ইদ্রিস ও নূহের বংশধর (’আলাইহিমুস সলাতু ওয়াস সালাম)।

    এ বিষয়ে অনারব ভাষার বাইবেলই যেহেতু সবচেয়ে প্রাচীন প্রাপ্ত উৎস এবং মূলত এর বা ইসরাঈলী বর্ণনার উপরেই ঐ সীরাত, তারীখ ও তাবাকাতের আরবিভাষী প্রণেতাগণ নির্ভর করেছেন – সেহেতু, নামগুলো আরবিতে তরজমা করতে গিয়ে তাঁদের বর্ণনায় মাঝে মাঝে বানানগত একটু পার্থক্য হয়েছে। এটা তেমন কিছুই নয়, বরং বড় সমস্যা হচ্ছে, এ নসবনামার যৌক্তিকতা কতোটুকু? বাইবেলের পুরাতন নিয়মের ৩টি (হিব্রু, গ্রীক ও শরমীয়) সংস্করণেই এর বিবরণে এতো পার্থক্য বা বৈপরীত্য রয়েছে – যা সমন্বয়ের অযোগ্য! যেমন – (০৬)

    ১। এ নসবনামার গ্রীক ও শরমীয় সংস্করণে অর্ফক্ষদ ও শেলহের মাঝে কৈনন নামে একজনকে ঢোকানো হয়েছে – যা লুকও অনুসরণ করেছেন। অথচ হিব্রু সংস্করণে ওখানে কৈনন নেই!

    ২। প্রথম সন্তান জন্মের সময় হযরত আদম ও ইদ্রিসের বয়স ছিলো হিব্রু ও শরমীয় সংস্করণের মতে, যথাক্রমে ১৩০ ও ৬৫ এবং গ্রীক সংস্করণের মতে, যথাক্রমে ২৩০ ও ১৬৫ বছর!

    ৩। ৩টি সংস্করণই বলছে যে, মহাপ্লাবনের সময়ে হযরত নূহের বয়স ছিলো ৬০০ বছর। আর হযরত আদম হায়াত পান ৯৩০ বছর। শমরীয় সংস্করণের মতে, হযরত আদমের ওফাতের সময়ে হযরত নূহের বয়স ছিলো ২২৩ বছর – যা বাকি ২ সংস্করণ ও সকল ঐতিহাসিকের মতে, বাতিল। হিব্রু সংস্করণের মতে, হযরত আদমের ওফাতের ১২৬ এবং গ্রীক সংস্করণের মতে, ৭৩২ বছর পর হযরত নূহের জন্ম!

    ৪। নূহের মহাপ্লাবন থেকে হযরত ইব্রাহীমের জন্ম পর্যন্ত সময় হচ্ছে, হিব্রু সংস্করণের মতে, ২৯২, গ্রীক সংস্করণের মতে, ১০৭২ ও শমরীয় সংস্করণ মতে, ৯৪২ বছর!

    ৫। হিব্রু সংস্করণের মতে, হযরত নূহের মহাপ্লাবনের ২৯২ বছর পরে, হযরত ইব্রাহীমের জন্ম হয়েছে। আর ঐ মহাপ্লাবনের পরে নূহ আরো ৩৫০ বছর বেঁচে ছিলেন, অর্থাৎ হযরত নূহের ওফাতের সময়ে হযরত ইব্রাহীমের বয়স ছিলো ৫৮ বছর – যা বাকি ২ সংস্করণ ও সকল ঐতিহাসিকের মতে, বাতিল। আর গ্রীক সংস্করণের মতে, হযরত নূহের ওফাতের ৭২২ ও শরমীয় সংস্করণের মতে, ৫৯২ বছর পরে হযরত ইব্রাহীমের জন্ম হয়!

    এমনই ভূরি ভূরি ভুলে ভরা বাইবেল! যাহোক, বলেছি যে, প্রথম ধাপ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে ইবনে হিশামের বর্ণনায় নবীজীকে হযরত ইব্রাহীমের ৩০শ (ত্রিংশ) এবং ইবনে সা’দ ও তাবারীর বর্ণনায় ৬২ম (দ্বিষষ্টিতম) বংশধর হিসেবে দেখানো হয়েছে! তেমনি, তৃতীয় ধাপে ইবনে হিশামের বর্ণনায় নবীজীকে হযরত আদমের ৪৯ম (ঊনপঞ্চাশত্তম), ইবনে সা’দের বর্ণনায় ৮২ম (দ্ব্যশীতিতম) ও তাবারীর বর্ণনায় ৮১ম (একশীতিতম) বংশধর হিসেবে দেখানো হয়েছে! কোনটি সঠিক? (’আলাইহিমুস সলাতু ওয়াস সালাম)

    বিজ্ঞান কী বলে? বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তবিদ ডঃ মুরিস বুকাইলি লিখেছেন: “আমরা জানি যে, মানুষের এক-একটি প্রজন্ম-পুরুষের গড় আয়ু পঁচিশ বছর। তাই, একটি শতাব্দী যেতে কমবেশি চার পুরুষের দরকার। এ গড় আয়ুর হিসেব শ’ শ’ বছর ধরে মানুষের পুরুষানুক্রমিক বংশধারার হিসেবের ছক থেকেই সাব্যস্ত হয়েছে।” তিনি আরো দেখিয়েছে যে, পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে, পঞ্চাশ লাখ থেকে অন্তত বিশ লাখ বছর আগে (০৭)!

    কাজেই, বিজ্ঞানের মতে, হযরত আদম মানব জাতির প্রথম পুরুষ হলে, তিনি পৃথিবীতে তাশরীফ এনেছেন নবীজীর অন্তত বিশ লাখ বছর আগে! আর প্রতি একশ’ বছরে চারজন পুরুষ হলে, বিশ লাখ বছরে হয় আশি হাজার পুরুষ। অথচ প্রচলিত দীর্ঘ নসবনামায় নবীজী হচ্ছেন, হযরত আদমের ৮২ম পুরুষ! ৪জন পুরুষ ১০০ বছরে এলে, ৮২জন পুরুষ আসবে ২,০৫০ বছরে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এ নসবনামার কতোই না পার্থক্য! কোথায় বিশ লাখ বছর ও আশি হাজার পুরুষ! আর কোথায় মাত্র দু’ হাজার পঞ্চাশ বছর ও ৮২ম পুরুষ!

    যদি বলেন, বিজ্ঞান মিথ্যে বলছে, বরং প্রচলিত বর্ণনাই সঠিক – তাহলে আপনাকে মানতে হবে যে, পৃথিবীতে মানুষ জাতির প্রথম পদার্পণ হয়েছে আজ থেকে মাত্র ৩,৫৪০ বছর আগে (অর্থাৎ নবীজীর আবির্ভাবের আগের ২০৫০ বছর, হিজরতের সময়ে তাঁর বয়স ৫৩ বছর এবং বর্তমান ১৪৩৭ হিজরীর যোগফল তথা ২০৫০+৫৩+১৪৩৭=৩৫৪০ বছর)! কিন্তু কোনো বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিই এটা মেনে নেবে না।

    ইসলাম কী বলে? মহান আল্লাহপাক ফরমান: আর আমি তার (নূহের) বংশধারা টিকিয়ে রেখেছি (৩৭:৭৭)। এর তাফসীরে ইবনে আব্বাস থেকে জানা যায় যে, নৌকা থেকে নামার পর, নূহের সাথীরা (ধীরে ধীরে) ইন্তেকাল করেন। শুধু তাঁর স্ত্রী ও সন্তানাদি টিকে থাকেন – যাঁরা বতর্মান বিশ্ববাসীর পূর্বপুরুষ।

    আল্লাহুতা’লা আরো ফরমান: যারা তোমাদের আগে ছিলো – নূহ, আদ ও ছামুদ সম্প্রদায় এবং ওদের পরবর্তীদের সম্পর্কে কি তোমাদের কাছে খবর আসেনি? আল্লাহ্ ছাড়া ওদের সম্পর্কে কেউ জানে না (১৪:৯)।

    মহানবী (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) বলেন: আল্লাহ্ ইব্রাহীমের সন্তানদের থেকে ইসমাঈলকে, ইসমাঈলের সন্তানদের থেকে বানূ কিনানাকে, কিনানা থেকে কুরাইশকে, কুরাইশ থেকে বানূ হাশিমকে এবং বানূ হাশিম থেকে আমাকে মনোনীত করেছেন (তিরমিযী)।

    তিনি আরো ফরমান: আমি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আবদে মান্নাফ ইবনে কুশাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবনে কা’ব ইবনে লূয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর ইবনে মালিক ইবনে নাদ্বর ইবনে কিনানা ইবনে খুঝাইমা ইবনে মুদরিকা ইবনে ইলইয়াস ইবনে মুদ্বার ইবনে নিঝার। মানুষের গোত্র যেখানে ভাগ হয়েছে, সেখানে আল্লাহ্ আমাকে উত্তর ভাগে রেখেছেন। যেমন- আমি বাবা-মা থেকে বৈধভাবে জন্মেছি। জাহিলিয়াতের ব্যভিচার আমার নসবনামা ছুঁতে পারেনি। আমার জন্ম বিয়ে থেকে; অবৈধ সম্পর্ক থেকে নয়। এ পবিত্রতার ধারা আদম থেকে আমার বাবা-মা পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চলে এসেছে। কাজেই, আমি ব্যক্তি হিসেবে তোমাদের মাঝে সেরা; বংশের দিক থেকেও (বায়হাকী ও ইবনে কাছীর)।

    হযরত উমর বলেন: আদনান পর্যন্ত নসবনামা পৌঁছানো যায় (ইবনে কাছীর)। তিনি আরো বলেন: আমরা আদনান পর্যন্ত বংশধারা বর্ণনা করে থাকি; এর উপরে যা আছে, তা আমরা জানি না (সুহাইলী)।

    হযরত ইবনে মাসউদ, আমর ইবনে মাঈমুন আল-’আওদী ও তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল-কুরাযী সূরা ইব্রাহীমের ৯নং আয়াত তেলাওয়াত করে বলতেন: “বংশবৃত্তান্তবিদরা মিথ্যে বলেছে” (ইবনে কাছীর)!

    হযরত ইবনে আব্বাস বলেন: “আদনান ও ইসমাঈলের মাঝে ত্রিশ পুরুষ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।” নসবনামা নবীজী থেকে মা’দ ইবনে আদনান পর্যন্ত পৌঁছলে, তিনি দু’ বা তিনবার বলতেন: “বংশবৃত্তান্তবিদরা মিথ্যে বলেছে।” তিনি আরো বলেন: আল্লাহ্ আঝঝা ওয়া জাল্লা সূরা ফুরকানে (৩৮নং আয়াতে) তা ফরক (পার্থক্য) করে দিয়েছেন: “(আমি) আদ, সমুদ, কুয়োবাসী এবং তাদের মাঝের বহু গোষ্ঠী (ধ্বংস করেছি)।” তিনি আরো বলেন: আল্লাহ’র রাসূল সল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা (পুরো নসবনামা) জানতে চাইলে, তিনি তা জানতে পারতেন (ইবনে খাইরাত, বালাজুরী, সুহাইলী ও ইবনে কাছীর)। (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহুম)

    ইমাম মালিককে কেউ বললো: এক লোক (নবীজীর) নসবনামা আদম পর্যন্ত জানেন। তিনি নাখোশ হয়ে প্রশ্ন করলেন: সে তা কীকরে জেনেছে? ইসমাঈল পর্যন্ত পৌঁছলেও তিনি তা অপছন্দ করে আবার প্রশ্ন করেন: কে তাকে তা বলেছে? এরপর তিনি বলেন: আদনান ও ইসমাঈলের মাঝের নসবনামা জানে – এমন কাউকে আমরা চিনি না। উরওয়া ইবনে যুবাইর থেকেও এমন বর্ণনা রয়েছে (সুহাইলী ও ইবনে কাছীর)। (’আলাইহিমার রাহমাহ)

    যাহোক, এ আলোচনায় পরিষ্কার হলো যে, নবীজীর প্রচলিত নসবনামার প্রথম ধাপটি বা আদনান পর্যন্ত সঠিক। বাকি দু’ ধাপ সংরক্ষিত হয়নি – যা শুধু আল্লাহুতা’লাই জানেন; নবীজী জানলেও উম্মতকে সম্ভবত জানাননি। তাই, সংশ্লিষ্ট বর্ণনাগুলো ত্রুটিপূর্ণ বা বিক্ষিপ্ত বা আংশিক। তবে, নবীজী যে হযরত নূহ, ইব্রাহীম, ইসমাঈল, কুরাইশ ও হাশিমের বংশধর – এতে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য তিনি হযরত শীছ ও ইদ্রিসের বংশধর কিনা – এ ব্যাপারে খুব মজবুত দলিল না থাকলেও বাইবেলের সব সংস্করণ, ইবনে হিশাম, ইবনে সা’দ, তাবারী প্রমুখের বর্ণনা মতে, তিনি তাঁদেরই বংশধর। তাছাড়া, ঐতিহাসিকরা বলেন: আদম তাঁর সন্তানদের ‌এবং তাঁদের সন্তানদের সংখ্যা চার লাখ হওয়ার পরেই ইন্তেকাল করেন! ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক বলেন: আজকের আদম-সন্তানদের সব বংশধারা শীছ পর্যন্ত গিয়েই শেষ হয়েছে এবং আদমের বাকি বংশধারাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে (ইবনে কাছীর)। আর অধিকাংশের মতে, ইদ্রিস নূহের দাদার বাবা। আর নূহ নবীজীর পুর্ব-পুরুষ। তাহলে, নবীজী হযরত শীছ ও ইদ্রিসেরও বংশধর বৈকি (’আলাইহিমুস সালাম)। তদুপরি, আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে, দুনিয়ায় বাবা আদমের পদাপর্ণ বিশ বা পঞ্চাশ লাখ বছর আগে হলেও এর সাথে ইসলামের কোনোই বিরোধ নেই। ধন্যবাদ।

    তথ্য-নির্দেশিকা:

    (০১) সীরাতে ইবনে হিশাম বলতে আব্দুল মালিক ইবনে হিশামের (ওফাত ২১২/২১৮ হিঃ) রচিত আস-সীরাতু নবভীয়াহকে বোঝায়।

    (০২) তাবাকাতে খলীফা বলতে ইমাম আহমাদ ও বুখারীর (’আলাইহিমার রাহমাহ) উস্তাদ ও বিশিষ্ট ঐতিহাসিক খলীফা ইবনে খাইয়াতের (১৬০/১৬১-২৩৯/২৪০ হিজরী) রচিত তাবাকাতকে বোঝায়।

    (০৩) তাবাকাতে ইবনে সা’দ বলতে মুহাম্মাদ ইবনে সা’দের (১৬৮-২৩০ হিজরী) রচিত কিতাবু তাবাকাতে কুবরাকে বোঝায়।

    (০৪) তারীখে তাবারী” বলতে ইমাম তাবারীর (২২৪-৩১০ হিঃ) রচিত তারীখুর রুসুল ওয়াল মুলূককে বোঝায়। এটিকে তারীখুল উমাম ওয়াল মুলূকও বলা হয়।

    (০৫) আর-রাওদ্বুল উনুফ হচ্ছে, স্পেনের ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুল্লাহ আস-সুহাইলীর (৫০৮-৫৮১ হিঃ) রচিত সীরাতে ইবনে হিশামের সেরা শরাহ বা ব্যাখ্যা-গ্রন্থ।

    (০৬) দেখুন, আল্লামা রহমতুল্লাহ কাইরানভীর (১২৩৩-১৩০৮ হিঃ) রচিত ইযহারুল হক।

    (০৭) দেখুন, ডঃ মুরিস বুকাইলির রচিত মানুষের আদি উৎস কী? (What is the Origin of Man?)। সুত্রঃ শেরশাহ’র শিরস্ক – The Helmet of Sher Shah