ভারতে ‘বউদি’দের দোলপুজোয় “জল আর রঙ”

    0
    326

    প্রতি বছর দোল ও কালীপুজোর আগে গণমাধ্যমে একটা খবর প্রকাশিত হয়, যার মর্মার্থ এই— এ বছর এই উৎসবে অতিরিক্ত পুলিশি সতর্কতা গৃহীত হচ্ছে। এই সতর্কবার্তা (ঝঞ্ঝার আগে সামুদ্রিক অঞ্চলে যেমনটা হয়) এতটাই ‘স্বাভাবিক’ আমাদের কাছে যে, আমরা এই প্রশ্ন কখনও তুলি না, ঠিক কোন আহ্লাদে এই দুই উৎসবে অতিরিক্ত সতর্কতার রাস্তায় হাঁটতে হয় পুলিশ-প্রশাসনকে? কালীপুজোয় বাজির কারবার, আগুন লেগে যাওয়ার ভয় রয়েছে। কিন্তু দোল? সেখানে তো জল আর রঙ। তা হলে প্রতি বছর কেন সতর্কতা? কেন ‘অতিরিক্ত’ সতর্কতা? এই পর্যন্ত পড়ে বুজুর্গ পাঠক নাক সিঁটকোতে পারেন। ইলেক্ট্রোক্ষিপ্ত পাঠিকা মুখ ঝামটে বলে উঠতেই পারেন— ন্যাকা! জানে না যেন, কী বেলেল্লাপনা দোলের দিন হয়! হ্যাঁ মহাশয়া, জানি। আর জানি বলেই বাঙালির দোল-বেলেল্লাপনার একটা সংক্ষিপ্ত ঝাঁকিদর্শন এখানে লেখার অপচেষ্টা করছি।

    বিহার প্রদেশ থেকে আগত এক বন্ধু জানিয়েছিলেন, তাঁদের মুলুকে দোল খেলা আরম্ভ হয় হোলির এক মাস আগে আর শেষ হয় হোলির এক মাস পরে। দু’মাস ধরে রং খেলা চলে— এই নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করায় তাঁর মন্তব্য ছিল, “হোলি যে রং নিয়েই খেলতে হবে, কে বলেছে? গ্রামের রাস্তায় কেউ হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁকে চার-পাঁচজন ঘিরে ধরে চ্যাংদোলা করে পাশের নর্দমায় ফেলে দিয়ে ‘হোলি হ্যায়’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেই তো খেলা জম-জমাট।” না। এ হেন আগ্রাসী ও দীর্ঘমেয়াদি দোল খেলায় বাঙালি বিশ্বাস রাখে না। কিন্তু এক দিনের বসন্তোৎসবে সে যা করে নেয়, তা সম্বৎসরের রসদ। খুব সাম্প্রতিকের ভাষায় বলতে গেলে—‘কেঁখে মস্তি’। এ হেন ‘মস্তি’র ঠেলা সামলাতে প্রশাসনের জিভ বেরিয়ে যেতে পারে। যায়ও। আর এই প্রাণান্ত কোনও সাম্প্রতিক হিড়িক নয়, এটা বাংলা বা বাঙালির কৌলিক।
    কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সেলিব্রেটেড কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তর কলকাতার কবিতা’-য় দোল নিয়ে অনবদ্য এক কবিতা লিখেছিলেন, যার প্রথম দুই পঙক্তি ছিল— “ধাঙড় বস্তিতে গিয়ে হোলির বাঁদুরে রং/ মেখে নিলে বোঝা যায় বসন্তের মর্মবেদনা”। সেই কবিতা শেষ হয়েছিল এই পংক্তিতে— “এবার বসন্ত গেল বাংলা মদ, তাসায়, আশায়”। পুরো কবিতা উদ্ধারের দরকার পড়ে না, শুরু আর শেষেই বোঝা যায় হোলির অন্তরে নিহিত বেদনার উৎস ঠিক কোথায়, তার অনুষঙ্গগুলিই বা ঠিক কী কী। দোল ততক্ষণ দোল নয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত তার অন্তঃস্থল থেকে নিঙড়ে বের করে আনা হচ্ছে এই বেদনাবোধকে। আর এই নিংড়ানোর পদ্ধতিটাই হল ‘মস্তি’, ‘কেঁখে মস্তি’।
    আজ থেকে তিরিশ বছর আগে কলকাতার সন্নিহিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহরতলিতে যাঁরা বেড়ে উঠেছেন, তাঁরা জানেন উপরোক্ত বেদনার প্রকৃত চেহারা। সকাল ন’টায় পাড়ার বাচ্চারা বালতিতে রং গুলে পিচকিরি আর বেলুন রেডি করে ছাদে বা বারন্দায় দাঁড়িয়ে থাকত। রাস্তা দিয়ে কেউ গেলেই তাঁর উপরে বর্ষিত হত সেই সব। এর ব্যত্যয় বোধ হয় আজও ঘটেনি। কিন্তু বেলা বাড়লেই শুরু যা শুরু হত, তাকে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলা যায়, ‘ফরাসি বিপ্লবের কালে বাস্তিল দুর্গের পতন’-ও বলা যেতে পারে। ততক্ষণে বাংলা মদের স্রোত ধাঙড় বস্তির চৌহদ্দি পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে মধ্যবিত্তির ঘেরাটোপে। অ্যাডাল্ট বাঙালি পুরুষ টাগরা জ্বলে যাওয়া চানাচুর সযোগে সেই বস্তু গলাধঃকরণ করে মেখে নিচ্ছেন রং, মাখিয়ে দিচ্ছেন রং, বেতালায় একটা বিহারি ঢোল কেউ পিটে চলেছে, অর্থহীন উল্লাসের ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত। দঙ্গলের পর দঙ্গল এই ভাবে মহল্লার পর মহল্লা টহল দিচ্ছে। শিশুপাল ততক্ষণে মায়ের হাতে ছোবড়ার রাম-ঘষা রাবণ-ঘষা খেয়ে রং তোলার নিমখাসা তরিবৎ সেরে স্নান করে জানলার পর্দা তুলে রাস্তার সেই কার্নিভ্যাল সভয়ে দেখছে। বয়ঃসন্ধির বালক ভাবছে, আর ক’বছর পরে আমিও…
    এই প্রকাশ্য কার্নিভ্যালের একটা অন্তরাল ছিল। সম্ভবত এখনও রয়েছে। সেটা এবাড়ি-ওবাড়ি আবির দিতে যাওয়ার একটা মিঠে রেওয়াজ। কিন্তু সেটাকেও নিরীহ ভাবলে ভুল করা হবে। গুরুজনদের পায়ে ছোঁওয়ানোর জন্য বিশুদ্ধ আবির থাকলেও, লঘুজনের উদ্দেশে প্রদেয় আবিরে মেশানো হত বাঁদুরে রং, যার ডাকনাম ছিল ‘ম্যাজেন্ডার’। এই লঘুজন বলাই বাহুল্য নারী। কিশোরী থেকে তরুণী গৃহবধূ (যাঁদের সর্বজনীন নাম ‘বউদি’)— এই বর্গে পড়তেন। স্নান করার সময়ে মাথা ঘসতে গিয়ে সেই বাঁদুরে রংয়ের স্রোত নামত সর্বাঙ্গ বেয়ে। কিন্তু ব্যাপারটা অতটা লঘু ছিল না, অতটা নিরীহও নয়। এই আবির মাখানোর অছিলায় পুংতন্ত্র প্রবিষ্ট হতো শরীরের নিষিদ্ধ অঞ্চলে। সেটাকে ‘মলেস্টেশন’ হিসেবেই দেখবে আইন। কিন্তু সেউ কার্নিভ্যালের উল্লাসে সেদিন সেটাও সিদ্ধ। কেউ এ নিয়ে সবিশেষ উচ্চ-বাচ্য করতেন না। এ যেন একটা সর্বজনসিদ্ধ-সর্বজনসম্মতিপ্রাপ্ত ব্যাপার। এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক, এটা ধরে নেওয়া হতো।
    বেলা বাড়লে বাংলা মদ আর গাঁজার দাপটও বাড়ত। নেশার অছিলায় যা বাড়তো, তাকে হিন্দিতে বলে ‘বাওয়ালি’। মাতালের বিজড়িত গলায় গান, চিৎকার, দলবদ্ধ হুল্লোড়, ঢোয়াল বা নালের দমকে কার্নিভ্যাল তখন উত্তুঙ্গ। এমতাবস্থায় মধ্যবিত্ত বাড়ির সদ্য শেভ করতে শুরু করা ছেলেটি ঝপাৎ করে ডিক্লাসড হওয়ার একটা মওকা পেয়ে যেত। ধাঙড় বস্তিতে গিয়ে বাংলা মদ আর ঋতুতাড়িত হয়ে অসফল প্রেমের আখ্যান একাকার হয়ে তখন বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা হয়ে বয়ে চলেছে হাইড্রেনের দিকে।

    সেই দোলের সবটাই যে ‘রঙিন’, তা কিন্তু নয়। সেই দোলের একটা বড় পর্বই ছিল রং-বহির্ভূত। রং তো সকালের মধ্যেই শেষ। আবির-টাবির নেহাতই অ্যামেচারিশ। বেলা দেড়টা বাজার পরে যাঁরা দোল খেলতে নামতেন তাঁদের অস্ত্র পোড়া মোবিল, ছাপার কালি থেকে শুরু করে বিড়ালের বিষ্ঠা পর্যন্ত। নর্দমার জল তুলে গায়ে দেওয়া বা কারোকে ধরে ড্রেনে চোবানো কোনও ব্যাপারই নয়। ‘সা রা রা রা হোলি হ্যায়’-সুলভ ধ্বনির সঙ্গে মিশে যেত অসাংবিধানিক শব্দের স্রোত। বাংলা-তাড়ি-গাঁজার ধুমকি ব্যারোমিটার ছাড়িয়ে ততক্ষণে মনুমেন্টের মাথায়। পোড়া মোবিল চোখে লেগে রীতিমতো আহত হয়েছেন, এমন ঘটনা তখন আকছার। আর রংও যে খুব নিরীহ ছিল তা নয়। সোনালি ও রুপালি রং পাওয়া যেত কাচের ছোট শিশিতে। নারকেল তেলে মিশিয়ে সেটা ব্যবহার করতে হত। চুল আর মুখ সোনালি করে রাজা মিদাসের জাদুস্পর্শধন্য চেহারা নিয়ে কত জন যে রাস্তায় ঘুরে বেড়াত, তার ইয়ত্তা নেই।
    তবে এই পুরো ব্যাপারটাই ছিল পুরুষতান্ত্রিক। এই কার্নিভ্যালে মেয়েদের প্রবেশ ছিল না। শ্রমজীবী পল্লিতে মহিলারা অনেক বেশি সক্রিয় থাকতেন। পুংতন্ত্র তাঁদের দিকে একধাপ এগোলে তাঁরাও আক্রমণ শানাতেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। উত্তর ভারতের লাঠমার হোলি পশ্চিম বঙ্গে অচল। তবে সারা বছর ধরে পুংতন্ত্রের বিপরীতে জমিয়ে রাখা ক্ষোভ যেন খেটে খাওয়া সমাজের মেয়েরা উগরে দিতেন এদিন। সেই হোলি সহিংস। সেখানে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির থসু থসু রংখেলা তুরুশ্চু। জেন্ডার সংগ্রাম সেখানে মূর্ত। উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট তখন যাবতীয় তত্ত্বসীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে।

    এই সব কি এখনও ঘটে? নাকি শান্তিনিকেতনি কেতায় পৌরসভা আর আবাসন-নিয়ন্ত্রিত দোলোৎসবে সাদা পাঞ্জাবি আর বাসন্তী শাড়িতে ইকো-ফ্রেন্ডলি আবির আর গুলালে ‘জলেস্থলেবনতলে’ খুচুর মুচুর? লালবাজার থেকে জানানো হয়েছে , এ বছর বহুতল বাড়িগুলির দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখবে। বহুতল থেকে রং বা বেলুন ছোড়া ঘোরতর বিপদ ডেকে আনতে পারে। নাঃ। এই আশঙ্কা কয়েক দশক আগেকার দোলে ছিল না। এ এক নতুন আপদ। প্রশাসন কম চেষ্টা করেনি এই ঘোরতর নৈরাজ্যবাদী কার্নিভ্যালকে ‘সুশীল’ করার। পাড়ায় পাড়ায় শান্তিপূর্ণ বসন্তোৎসবের আয়োজন তো সেদিনের ঘটনা। সেই সাদা পাঞ্জাবি-বাসন্তী শাড়ির দল ‘খোল দ্বার খোল’ গাইতে গাইতে জনপদ বা আবাসন একবার পাক মেরে ঘরে ঢুকে যায়। তার পর? তার পরে শুরু হয় আসল খেল। পাঁচিলবন্দি আবাসনে হয়তো প্রবেশ করে না সেই ঢেউ। ‘বসন্তে ফুল গাঁথল’ নিচু ভল্যুমে চালিয়ে হয়তো ড্রয়িংরুমে হালকা সুবাস ভাসে ব্ল্যাক বা রেড লেবেলের। রান্নাঘর থেকে সাপ্লাই হতে থাকে চিকেন পকোড়া। সে এক অন্য জগৎ, তার সঙ্গে বাইরের গাজনের কোনও সম্পর্ক নেই।

    বাইরে তখন মদনোৎসব তুঙ্গে। মনে পড়ে যেতেই পারে ১৯৮৪ সালে গিরিশ কারনাডের তোলা ছবি ‘উৎসব’-এর কথা। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ অবলম্বনে তোলা সেই ছবির ক্লাইম্যাক্স ছিল এক বসন্তোৎসব। যেখানে একাধারে প্রেম, চৌর্যবৃত্তি, নারীলোলুপতা, মৃত্যুদণ্ড এবং রাষ্ট্রবিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে। কারনাড মাস্টারস্ট্রোক খেলেছিলেন সেখানে। মিখাইল বাখতিন তাঁর থিওরি নিয়ে যেন স্বয়ং হাজির হয়েছিলেন সেই কার্নিভ্যালে। কী না সম্ভব সেখানে! যে কোনও ইচ্ছেই মূর্ত হয়ে উঠতে পারে সেই গণহিস্টিরিয়ার অবকাশে। নড়ে যেতে পারে যে কোনও মহাফেজখানা। ফলে সতর্ক তো থাকতেই হবে। প্রেম, চৌর্য, লালসা, হন্তারকবৃত্তি পেরিয়ে উৎসব যদি প্রবেশ করে রাষ্ট্রবিপ্লবের রাস্তায়!

    নাঃ। অতটা ভাবা বোধ হয় ঠিক নয়। বাঙালির দোল আসলে একদিনের বেলেল্লাপনার লাইসেন্স। অন্য কোনও উৎসব তো এতটা ফিজিক্যাল প্রক্সিমিটি অনুমোদন করে না! কাছাকাছি আসার সুবাদে ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনাভাইরাসও। তাই এ বছর অতিরিক্ত সতর্কতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও কি দমানো যাবে কার্নিভ্যালকে? যে শহরতলির কথা বলে এই লেখা শুরু করেছিলাম, সেই সব শহরতলিও তাদের চরিত্র বদলেছে। ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট’ বলতে এ রাজ্যে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। তার বদলে পুরোটাই আবাসন। কাজেই সেই ‘ধাঙড় বস্তিতে গিয়ে হোলির বাঁদুরে রং’ মেখে নিয়ে নৈরাজ্যের দিকে চলে যাওয়ার কোনও সুযোগ আজ আর খুব একটা রয়েছে বলে মনে হয় না। কিন্তু কোথাও কি আজও রয়েছে কিছু ঘনিয়ে ওঠার সম্ভাবনা? রং-বেলুন-পিচকিরি-আবির পেরিয়ে সেটা কি অনির্ণেয় কোনও ধূসর জায়গায়? তাই কি আগাম সতর্কতা?

    চারপাশ থেকে ঝাড় খেতে খেতে কোণঠাসা অস্তিত্বের ফাঁক দিয়ে কি বেরিয়ে যাওয়া যায় এই উৎসবের অবকাশে? রাষ্ট্রীয় রক্তচোখ, শাসনের বেড়াজাল, নাগরিক-অনাগরিকত্বের কাজিয়া, সংখ্যার লঘু-গুরত্বের চাপান-উতরকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে পারে এই উল্লাস। তাই আজও আগাম সতর্কতা, সাবধানে থাকার কুচকাওয়াজ। কে জানে, এই বসন্তের বুকের ভিতরেও আগুন আছে কি না! কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই। নইলে কেন… আনন্দ বাজার থেকে