বিস্ময়কর উদ্ভাবক ধানশিল্পী হরিপদ কপালী !

    0
    302
    “প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কিংবা আমলাতান্ত্রিক বাহাদুরি এসব প্রমাণ পছন্দও করে না। মানে এরা কৃষক, জেলে, মজুরের উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। তাদের মতে, ধান জাত উদ্ভাবন করবেন একজন উদ্ভিদ প্রজননবিদ বা কৃষিবিজ্ঞানী। জুম-জমিনের একজন কৃষক তো ‘চাষা’, সে কেন উদ্ভাবক বা প্রজননবিদ হবে ? বৈষম্যমূলক এমন দৃষ্টিভঙ্গির ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে কৃষকের জ্ঞান ও শ্রমের মজবুত পাটাতন প্রমাণ করে চলেছেন গ্রাম-বাংলার অনেক কৃষক”

    আমার সিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৭জুলাই,পাভেল পার্থঃ  হাজার বছর ধরে কৃষক নারী-পুরুষেরাই উদ্ভাবন করেছেন এবং করে চলেছেন শস্য ফসলের হাজারো জাত। এক এক অঞ্চলে তার এক এক নাম তারাই রেখেছেন। কিন্তু এমন নথি ও দলিল নেই কোন কৃষক বা কোন একদল কৃষক কোন জাতটি উদ্ভাবন করেছেন। যেমন, হাওরাঞ্চলের একটি গভীর পানির ধান রাতা কিংবা রাঙামাটির পাহাড়ি জুমের ধান খবরক। এসব ধান জাত কে উদ্ভাবন করেছে? হয়তো কোনো প্রমাণসাপেক্ষ কোনো উত্তর নেই।

    আবার অধিপতি জ্ঞানব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কিংবা আমলাতান্ত্রিক বাহাদুরি এসব প্রমাণ পছন্দও করে না। মানে এরা কৃষক, জেলে, মজুরের উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। তাদের মতে, ধান জাত উদ্ভাবন করবেন একজন উদ্ভিদ প্রজননবিদ বা কৃষিবিজ্ঞানী। জুম-জমিনের একজন কৃষক তো ‘চাষা’, সে কেন উদ্ভাবক বা প্রজননবিদ হবে? বৈষম্যমূলক এমন দৃষ্টিভঙ্গির ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে কৃষকের জ্ঞান ও শ্রমের মজবুত পাটাতন প্রমাণ করে চলেছেন গ্রাম-বাংলার অনেক কৃষক। নিয়ানডার্থাল, জুরাসিক, লোহা যুগ বা মৌর্য আমল নয়। পাল, সেন বা মোঘল সাম্রাজ্য নয়। ব্রিটিশ, পাকিস্থান বা সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ নয়। এখনো কৃষকদের এই জাত উদ্ভাবনের চর্চা টিকে আছে।

    এখনো কৃষকেরা কেবলমাত্র ‘চাষা’ নন, প্রমাণ করে চলেছেন তারা ধানশিল্পী এবং এক একজন বিস্ময়কর বিজ্ঞানী। খাগড়াছড়ির ফকুমার ত্রিপুরা উদ্ভাবন করেছেন ফকুমার ধান, সুনামগঞ্জের নুয়াজ আলী ফকির চুরাক ধান, গাইবান্ধার রঞ্জু মিয়া সোহাগ-৪ ধান, ঝিনাইদহের মকবুল হোসেন মকবুল ধান। তালিকাটি এভাবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।

    স্মরণে রাখা জরুরি বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখনো পর্যন্ত ১০০টি ধান জাত উদ্ভাবন করেনি। অথচ শত-সহস্র জাত উদ্ভাবন করেও কৃষকেরা উদ্ভাবক ও প্রজননবিদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি।

    গ্রাম-বাংলার লাখো-কোটি স্বীকৃতিহীন কৃষকেরই একজন হরিধানের উদ্ভাবক হরিপদ কপালী। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের আসাননগর গ্রামের এই কৃষক ‘বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন প্রক্রিয়ার’ মাধ্যমে হরিধান উদ্ভাবন করেন। জাত উদ্ভাবনে বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন একটি বহুল প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। যেখানে কোনো বাছাইকৃত জাতের বীজ আলাদা লাগিয়ে সেখান থেকে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য দেখে কোনো সারি বাছাই করে পরপর কয়েকবছর চাষ করা হয়। এভাবে পর পর কয়েক বছর চাষ করার ভেতর দিয়ে একটি বিশুদ্ধ জাত নির্বাচিত হয়।

    বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট অনেক ধান জাত এই পদ্ধতিতে উদ্ভাবন ও ছাড় দিয়েছে। যেমন, ব্রি-ধান-৫ মানে হলো দুলাভোগ নামের এক স্থানীয় ধানের বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন। ১৯৭৬ সনে দান জাতটি ছাড় দেয়া হয়। ব্রিধান-২৬ হলো খাসকানি ধানের বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন। হরিপদ কপালী তাই করেছিলেন। তবে এতে তার দীর্ঘদিনের ভালবাসা, শ্রম, স্বপ্ন এবং সৃষ্টিময়তার এক প্রবল হাতছানি জড়িয়ে ছিল। মা সুরধনী বিশ্বাস ও বাবা কুঞ্জলাল বিশ্বাস শৈশব থেকেই হরিপদকে শিল্পীর স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই দেখা যায় বাবলা কাঠ দিয়ে কৈশোরেই হরিপদ তৈরি করেছেন ময়ূর-লাঙ্গল, সর্প-মই, কারুকাজ করা হুক্কা, নকশা পিঁড়িসহ নানা শৈল্পিক কৃষি উপকরণ। হরিপদর আর কোনো ভাই-বোন ছিল না বলে তার শৈশব ও কৈশোর কাটে চারধারের জমি, জলা আর জনজীবনের সাথে খেলায় খেলায়। বাঁশের টুকরির ভেতর পাটের ভেজা বস্তা, তার ভেতর জাগ দিয়ে রাখা হতো ভেজা ধান বীজ। ধীরে ধীরে গম পেয়ে অংকুরিত হতো বীজদানা। প্রকৃতির এমনসব পরিবর্তন তাঁর চিন্তাজগতে নাড়া দিয়েছিল।

    হরিপদ দেখেছেন তার দাদু এমনকি বাবার সাথে তিনি কিছুদিন চাষ করেছেন মেঘনাল, বিরবল, সুরথা, খরচামুড়ি, ঘৃত্ত্যকলা, ভইশদল ধান। হরিপদর প্রথম যৌবনে নিজের চোখের সামনে একে একে খুন হয়ে যায় সব দেশি ধানের জাত। মাঠ-ঘাট দখল করে ফেলে উচ্চফলনশীল বীজ। মাটির তলা থেকে জল টেনে তুলে, সার, বিষ দিয়ে এক হুলুস্থুলের কৃষি উন্নয়ন শুরু হয়। হরিপদ দেশি জাত বাঁচাতে নানাসময় তর্কে জড়িয়ে পড়েন কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে। তাদের একটাই হিসাব ধানের ফলন বেশি দরকার, দেশি জাতে ফলন কম। হরিপদ খুঁজে বেড়ান তার আদি ধান জাতদের গুণাবলী, মাঠে-ময়দানে পড়ে থাকেন। খুঁজে খুঁজে কিছু জাত সংগ্রহ করেন, কখনো এক জাতের সাথে আরেক জাতের মিলন ঘটান। কত পরীক্ষা আর কত নিরীক্ষা। ১৯৭০ সনে একবার এমন এক ভিন্ন ধান জাত খুঁজে পান। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিশাল আখ্যানে সেই ধান যেন কোথায় হারিয়ে যায়। এরপর আরো কয়েকবার কিছু জাত নিয়ে তিনি পরীক্ষা করেন। শেষমেষ সফল হন ১৪০৯ বাংলায়। তাঁর উদ্ভাবিত এক ধান জাতকে কৃষক সমাজ নাম দেয় ‘হরিধান’। ফলন, স্বল্পব্যয়ী ও টিকে থাকার বিস্ময়কর গুণের সমন্বয়ে এই হরিধান খুব সহজেই অল্প সময়ে বাংলাদেশের কৃষিজমিনে পৌঁছে যায়।

    যদিও এই ধানবীজ ও ‘হরিধানের’ নামের সুনাম নিয়ে কিছু প্রভাবশালী বীজ ব্যবসায়ী ও কোম্পানি নানা প্রতারণামূলক বাণিজ্য ও একতরফা মুনাফা লুটে চলেছে।

    ১৪০৫ সালে ভুই (জমিন) এর আগাছা বাছতে গিয়ে এই ধানের চারা খুঁজে পান হরিপদ কপালী। নিজেদের পারিবারিক জমিন রত্নাখালের ধারে কদমতলার কুঁড়ো বিল জমিন বা ভাগারের ভুইয়ের বুনো ঘাসের ভেতর থেকেই পাওয়া গিয়েছিল হরি ধানের আদি রূপকে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের বিশুদ্ধ সারি নির্বাচনের মাধ্যমে এই জাত সামাজিকভাবে ছাড় পায়। ১৪০৯ সামাজিকভাবে গ্রামের মানুষ এই এর নাম দেয় হরিধান। গ্রামের পর গ্রাম, জেলার পর জেলায় এই ধান ছড়িয়ে পড়ে। দৈনিক জনকন্ঠ, প্রথম আলো, চ্যানেল আইতে হরিধান নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের ভেতর দিয়ে হরিধান নিয়ে একটা সাড়া তৈরি হয়। নারায়ণগঞ্জের শ্রুতি নামের এক সাংস্কৃতিক সংগঠন, ১৪১১ বাংলায় বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে। হরিপদ কপালী বারসিক আয়োজিত ‘জাতীয় বীজ সম্মেলন ১৪১১’ উদ্বোধন করেন।

    হরিধান গাছের উচ্চতা আড়াই থেকে তিন হাত বা আরো বেশী। ধানের রঙ সাদা (পাকা ধানের রঙ সোনালী), চালের রঙ সাদা ফকফইক্ক্যা। প্রতি বিঘায় ফলন ১৮-১৯ মণ। একটা সময় পর্যন্ত বোরো মওসুম পুরোটাই দখল করেছিল ব্রিধান-১১। কিন্তু এটি বদলে সকল জমি হয়ে ওঠে হরিধানের। বোরো ও আমন উভয় মওসুমে এই ধান চাষ করে নানা নিরীক্ষা করেছেন নানা অঞ্চলের কৃষক। হরিধানের প্রতি কৃষকসমাজের আস্থা, বিশ্বাস ও  ভালবাসা এই প্রথম রাষ্ট্রীয় ধান গবেষণার বাহাদুরিকে একটা প্রশ্ন করতে পারল। একেবারে প্রমাণ ও পাবলিক দলিলসহ। হরিধান নিয়ে রাজনীতিও কম হলো না। ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান হরিধানকে কোনোভাবেই একটি স্বতন্ত্র উদ্ভাবিত জাত হিসেবে মেনে নিতে পারল না।

    এ নিয়ে সকল রকমের বৈজ্ঞানিক দলিল প্রমাণ বাদ রেখে তারা পিতা-পুত্রের এক অহেতুক দ্বন্দ্বকে গণমাধ্যমে ‘রটিয়ে’ দিল। প্রতিষ্ঠান প্রমাণ করতে চাইল হরিধানকে পাওয়া গেছে ব্রিধান-১১ এর ধানজমিন থেকে। কিন্তু হরিপদর বিজ্ঞান গবেষণা গুরুত্বহীন হয়েই রইলো। এখন বোঝা দরকার কেন হরিধান ব্রিধান-১১ থেকে আলাদা এবং কেন কৃষক সমাজে এই জাত অল্পদিনেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠল। যেকোন জমিনেই এই ধান চাষ করা যায়। ডেঙ্গা ও ডুব/ডুপ এরকম সব জমিতেই চাষ করা যাচ্ছে। সবচে’ ভালো হয় কুর/কুড় জমিনে। কুর মানে হল এমন জমি যেখানে বর্ষাতে পানি আসে। গড় পড়তা ধান ও খড়ের ফলন ভালো। দেশীয় পদ্ধতিতে চাষ করা যায়, চাষে সময় ও কষ্ট কম লাগে। রোগবালাই নেই। চাষের খরচ অনেক কম। ভাত সুস্বাদু। বিলের জমিনে সব ধান তলিয়ে গেলেও এই ধান টিকে থাকতে পারে।

    রাষ্ট্র হরিপদ কপালীকে স্বীকৃতি দেয়নি, তাই বলে জাত ও বীজের বিশুদ্ধতা রক্ষা করবে না। হরিধানের নিরাপত্তা দেবে না? একতরফাভাবে আজ ‘হরিধান’ নামে দেশের যেকোনো জায়গায় ধান বীজ বিক্রি হয়। কিন্তু ‘হরিধান’ নামে বিক্রি হওয়া সব বীজ ও জাত হরিপদ কপালী উদ্ভাবিত ‘হরিধান’ নয়। হরিধান বীজের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণে কোনো নজরদারি নেই।

    খারাপ বীজ ও ভিন্ন জাতকে ‘হরিধান’ হিসেবে বিক্রি করার ভেতর দিয়ে অন্য ক্ষতির পাশাপাশি উদ্ভাবক হরিপদ কপালীরও যে সুনাম ক্ষুন্ন হয় তা কী রাষ্ট্র বিবেচনা করবে না?

    বিরল কৃষিজ্ঞানের অধিকারী হরিপদ কপালী ৬ জুলাই ২০১৭ ভোরে তাঁর নিজ বাড়ি আসাননগরে মহাপ্রয়াণের পথে যাত্র করেছেন। মৃত্যুকালে স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়-স্বজন পাশাপাশি হরিধানের মতো এক আশা জাগানিয়া ধানজাত রেখে গেছেন তিনি। পারিবারিক নাম হরিপদ বিশ্বাস হলেও, গণমাধ্যম তাকে পরিচিত করায় ‘হরিপদ কপালী’ হিসেবে। হরিধান উদ্ভাবনের দীর্ঘ ১৮ বছর পাড়ি দিলেও রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক মনস্তত্ব বদলায়নি। একজন কৃষককে ‘উদ্ভাবক’ ও বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতিদানে আমাদের কি কি বদলাতে হবে? কেন আমরা সেসব বদলাচ্ছি না? লেখকঃপ্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক।