ফ্রান্সের শাঁতো দ্যু ভার্সাইয়ে একদিন

    0
    362

    আমার সিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২৫জুলাই,দেলওয়ার হোসেন সেলিম,প্যারিস ফ্রান্সঃ ফ্রান্সের শাঁতো দ্যু ভার্সাই বিশ্ব বিখ্যাত একটি দুর্গ। একটি প্রাচীন রাজকীয় প্রাসাদ। এই প্যালেস অব ভার্সাইতে ফ্রান্সের রুপকার রাজাগণ বসবাস করেছিলেন। তাদের মধ্যে কিং লুই চতুর্দশ, চার্লস এক্স, লুই ফিলিপ, নেপোলিয়ানের নাম উল্লেখ যোগ্য। ১৬৮২ থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের রাজধানী ছিলো ভার্সাইয়ে। ফরাসী সম্রাট ত্রয়োদশ লুই সর্বপ্রথম ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে ইট ও পাথর দিয়ে ভার্সাইয়ে একটি হান্টিং লজ নির্মাণ করেন। সেটাই ছিলো শাঁতো দ্যু ভার্সাইর সুচনা। এরই ধারাবাহিকতায় ফরাসী নৃপতি লুই চতুর্দশ নিজের বাস ভবন হিসেবে বিশাল প্রাসাদ ও উদ্যান বানান। ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রাসাদের নির্মাণ কাজ পুর্নতা পায়। এরপর ফরাসী বিপ্লবের পর শাঁতো দ্যু ভার্সাইকে আরো সুন্দর ও পরিপূর্ণ করা হয়, নতুন ডিজাইনার দিয়ে। পরে ইউরোপের অপরাপর শাসক তাদের নিজস্ব “ভার্সাই” নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ফরাসী সম্রাটের বাস ভবনটি হয়ে যায় পৃথিবীখ্যাত রাজপ্রাসাদ। বিশাল আয়তনের মনোরম পরিবেশে অবস্থিত ঐতিহাসিক এই রাজপ্রাসাদ দেখতে প্রতিদিন দেশী বিদেশী অসংখ্য পর্যটক ভীড় জমান। প্যারিস থেকে মাত্র ২১ কিলোমিটার দুরত্বে শাঁতো দ্যু ভার্সাই অবস্থিত। ইউনাইটেড ন্যাশন্স এডুকেশন, সাইন্স এন্ড কালচারাল অরগনাইজেশন (ইউনেস্কো) কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রণীত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্হান প্যালেস এন্ড পার্ক অব ভার্সাই। ভার্সাই শহরটি অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এখানে রয়েছে বড় প্রসস্ত সোজাসুজি রাস্তা, সারি সারি গাছগাছালি আর ফুলফলের সমারোহ। প্রাচীন হাট বাজার, অফিস, আদালত, ইউনিভার্সিটি সহ গোটা ভার্সাই নগরের সবই পর্যটকদের আকর্যণীয়। ভার্সাই রাজপ্রাসাদের চোখ ধাঁধাঁনো মনুমেন্ট স্মৃতিস্তম্বের ঐতিহাসিক রাজকীয় চরিত্রগুলোর উপস্থিতি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না কতই সুন্দর।

    ২৮ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে সিক্যুর ক্যাথলিক রেসিউ মনডিয়াল কারিতাস, সেন্ট কোয়ান্টিন এ ইভলিন (৭৮) ব্যুরো অফিসের আমন্ত্রণে আমি শাঁতো দ্যু ভার্সাই পরিদর্শন ও পিকনিকে অংশ গ্রহণ করি। সিক্যুর ক্যাথলিক কারিতাসের ডিরেক্টর ম্যাডাম মিশেল এ পিয়েখ গ্রালকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানাই। ফ্রান্সে বসবাসরত বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন পেশার আমন্ত্রিত লোকজনদের নিয়ে ঐদিন শাঁতো দ্যু ভার্সাইয়ে আনন্দ ভ্রমন ও পিকনিক অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ গ্রহণকারীদের কয়েক ঘন্টার জন্য যেন অন্য এক ভুবনে নিয়ে গিয়েছিল, যেখানে হয়তো অনেকেই কখনো যাননি! এমনকি স্বপ্নেও! প্রসংগত উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক ক্যাথলিক কারিতাস মানুষের সেবায় নিয়োজিত। বিশেষ করে ফ্রান্সে আশ্রয়প্রার্থী মানুষদের এড্রেস সহ বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। এছাড়াও নিয়মিত সাংস্কৃতিক, বিনোদনমুলক কার্যক্রম, ভ্রমণ, পিকনিক ইত্যাদি আয়োজন করা হয়ে থাকে। এসব কার্যক্রম বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। সেদিন নির্ধারিত সময়ে সিক্যুর ক্যাথলিক কারিতাসের সেন্ট কোয়ান্টিন অফিসের কাছাকাছি স্হান থেকে কর্মকর্তা ও সেচ্ছাসেবকরা বাসে আমাদেরকে নিয়ে রওয়ানা হন। প্রায় ১৫ মিনিট পরে আমরা শাঁতো দ্যু ভার্সাই পৌঁছে ফরাসী সুস্বাদু খাবার খাই। আনন্দ মনে ফটো /সেলফি তোলতে থাকেন অনেকেই।

    শাঁতো দ্যু ভার্সাইয়ে রাজকীয় ফটকের ভিতরে মস্ত বড় এক প্রাঙ্গণকে তিন দিকে ঘিরে চওড়া কাঁধ বলশালী পুরুষের মতো সামনে দু’হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ইমারত। ইমারতের ঠিক মাঝে ফঁতেনব্লোর পরিচয় চিহ্ন হয়ে যাওয়া সেই বিখ্যাত অশ্বক্ষুরাকৃতি সিড়ি। দু’ধারে যেন উইম্বলডনের চারটে সেন্টার কোর্ট। উপমাটা লাগসই। কারণ এইসব প্রাসাদেই ফরাসী রাজারা টেনিস খেলার উদ্ভব করেছিলেন। যাজকদের আশ্রম ভেঙ্গে নির্মিত পশ্চিমের এই ইমারতটির পিছনে আরও পুর্বে আছে শিকার গৃহ ভেঙ্গে মূল প্রাসাদ। মাঝে যোগসূত্র আড়াইশো ফুট লম্বা খিলান যুক্ত এক অলিন্দ। যার একতলার স্নাগারে ফ্রান্সিস নিভৃতে উপভোগ করতেন লিও নার্দোর লা জোকন্ডা অর্থাৎ মোনালিসার সান্নিধ্য। দোতলায় তৈরি হল রেসো, প্রিম্যাতিচ্ছের নতুন ধরনের ছবিতে সাজানো ফরাসী রেনেসাঁর আদি নিদর্শন বলে খ্যাত ফ্রান্সিস গ্যালারি। পুবমুখো মুল প্রাসাদের বহিরঅংশে শুধু মাত্র কিছু করিন্তিয়ান ঢং- এর কলাম আর কলোনেড , সোনার পাথে বাধানো আর্চ করা জানালা আর খাজকাটা ইটের পিল্যাস্টার। এই বহুভুজ সুবিশাল প্রাসাদকে ঘিরে দিঘী, ফোয়ারা, জলপথ, বাগান, গাছপালা, ফুল ফল, বিস্তৃত উদ্যান। আর প্রাসাদের সামনে উচুঁ একটি ঘোড়ার মুর্তির উপরে বানানো হয়েছে কিং লুই চতুর্দশের মুর্তি। দেখে মনে হয় বিশ্ব নন্দিত রাজপ্রাসাদটি দেখতে আসা পর্যটকদের তিনি স্বাগতম ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।

    বহু মূল্যবান মার্বেল, সোনা, রুপার পাথে ঘেরা নানান দুষ্প্রাপ্য শিল্প সম্ভার, ঝকঝকে ছবি, নজরকাড়া মুর্তি আর রকমারি আলোকসজ্জা দিয়ে প্রাসাদের ঘরগুলো নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর। যা দেখে অনুভব করা যায় রাজা রানীদের নিত্য দিনের আরাম আয়েশের বিষয়। ক্যাথলিক ধর্ম রাজাদের জীবন যাত্রার কতখানি জুড়ে ছিলো। তা বুঝা যায় প্রাসাদের প্রধান চ্যাপেল ট্রিনিটির জমকালো অন্দরসজ্জায়। রাজা, রানী ও তাদের সন্তানদের এবং আত্বীয় স্বজনদের পৃথক পৃথক সুরম্য অট্টালিকা। ভার্সাই প্রাসাদে কক্ষের সংখ্যা মোট ১ হাজার ৮ শ। কাসল স্হাপত্য সাদৃশ্য, প্রাচীন রাজকীয় এই বাসভবনের আয়তন প্রায় ৮ হাজার স্কয়ার হেক্টর। এর আশ পাশে ও আন্ডারগ্রাউন্ড জুড়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী স্হাপনা, গার্ডেন ও পার্ক, লেক, ঝরণা সমুহ।

    শাঁতো দ্যু ভার্সাইয়ে যাহা দেখার আছে, তাহা হলো : প্লেস দ্য আর্ম, কর্টয়ার্ড অব অনার, রয়্যাল কর্টয়ার্ড, মার্বেল কর্টয়ার্ড, নর্থ উইং, সাউথ উইং, মিনিস্টার্স নর্থ উইং, মিনিস্টার সাউথ উইং, এপোলো ফন্টিন, ইনসালাডস গ্রোভ, কিংস গার্ডেন, চেষ্টনট থ্রিজ রুম, কলনেড গ্রোভ, ডম্স গ্রোভ, মিরর ফন্টিন, গ্রীন কার্পেট, জিরান্ডাল গ্রোভ, ডফিন্স গ্রোভ, লেঠোনা ফন্টিন এন্ড পারটের, বেলরুম, এপোলো বাথ্স গ্রোভ, ওয়াটার পারটের, থ্রি ফন্টিন, নেপচুন ফন্টিন, ড্রাগন ফন্টিন, ওরান্জেরি, সাউথ পারটের, নর্থ পারটের, ট্রায়ামফল আর্কশ গ্রোভ, সেটার্ন ফন্টিন, বাকাস ফন্টিন, কুইন্স গ্রোভ, অবলিস্ক গ্রোভ, ফ্লোরা ফন্টিন, স্টার ফন্টিন, সেরিজ ফন্টিন, ওয়াটার ওর মারমুসেট্ ওয়াক, নেম্পস বাথ, পিরামিড, ডাউন ফন্টিন, নাইট ফন্টিন, ওয়াটার থিয়েটার গ্রোভ, চ্যাপেল, ফ্রেন্চ গার্ডেন, ফ্রেন্চ পাভিলিয়ন, কুইন্স থিয়েটার, রক, বিউদুয়া, কেটালপাস ক্লিয়ারিং, যিসূ গার্ডেন, লেন্ডস্কেপ গার্ডেন, টেম্পল অব লাভ, কুইন্স হাউজ, মার্লবুরুজ টাওয়ার, রেফরেশমেন্ট ডেইরি, মিল,বদুয়ার, ওয়ার্মিং রুম, ফার্ম, হর্শশে ফন্টিন, বটম ফন্টিন, ওয়াটার সাইড বোর্ড, অ্যমিপথিয়েটার, গ্রীন গ্রোভ, যিসূ প্যাভিলিয়ন ইত্যাদি। আমি মনে করি, ঐতিহাসিক ভার্সাই ভ্রমনে আসলে পুরো ১ দিন সময় নিয়ে আসা উচিত। ইন্টারনেটে টিকিট কনফার্ম করে আসলে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। চাইলে রাজপ্রাসাদের আউটডোরের বিভিন্ন অংশ ইলেকট্রিক কার এবং মিনি ট্রেনে চড়ে দেখতে পারেন। লেকের স্পিড বোট ভাড়া নিয়ে পানিতে দৌড়াতে পারবেন। বাইসাইকেল ভাড়া করেও ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে। ইনডোরের সব কিছু ঘুরে দেখতে দেখতে যদি ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তাহলে গ্যান্ড ক্যাফে, গার্ডেনের কোনায় কোনায়, ফোয়ারার পাশের রেস্টুরেন্টে, ফাস্ট ফুডের দোকানগুলিতে বসে হালকা নাস্তা করে নিতে পারেন। তবে এখানকার দোকানগুলোতে খাদ্য সামগ্রীর দাম একটু বেশি। নিজের পছন্দের খাবার সাথে নিয়ে প্রবেশ করলে পিকনিক স্পটে বসে খেতে পারবেন। আর প্রবেশের আগে ইনফরমেশন অফিস থেকে বিনামূল্যে ম্যাপ, ইস্টেট অব ভার্সাইর নির্দেশিকা সংগ্রহ করতে ভুলবেন না।

    ভার্সাই শহরে আমাদের বাংলাদেশের বাঙ্গালী কবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত বসবাস করেছিলেন। ভার্সাইর বিশ্ব নন্দিত রাজপ্রাসাদ ও এখানকার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবির জন্য ছিলো উপরি পাওয়া। তাই প্রায়ই অনাহারে, অর্ধাহারে কাটানো চরম দুর্দশার মধ্যেও ভার্সাইয়ে বসে মহা কবি মধুসুদন রচনা করতে পেরেছিলেন তাঁর বিখ্যাত চতুর্দশপদী কবিতা (সনেট)। কালজয়ী কবিতাটি প্রথমে ইন্ডিয়ার কোলকাতায় রচিত হলেও পরে ভার্সাইয়ে তিনি কবিতাটি নতুন করে লিখেছিলেন। প্রিয় কবির সেই কবিতাটি এখানে তুলে উল্লেখ করছি।
    কপোতাক্ষ নদ
    – মাইকেল মধুসুদন দত্ত
    সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
    সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
    সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে
    শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলতনে
    জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।
    বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে
    কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে
    দুগ্ধস্রোতরুপি তুমি মাতৃভুমি স্তনে।
    আর কি হে হবে দেখা যতদিন যাবে
    প্রজারুপে রাজরুপ সাগরেরে দিতে
    বারি রুপ কর তুমি এ মিনতি গারে
    বঙ্গজ জনের কানে সখে- সখারিতে।
    নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে
    লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে।

    ভার্সাই প্রাসাদের মিরর হলে একটি শান্তিচুক্তি যাহা প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরপর যুদ্ধের মিত্রশক্তি ও তৎসংশ্লিষ্ট শক্তি সমুহ এবং জার্মানির মধ্যে সম্পাদিত হয় ২৮ জুন, ১৯১৯ সালে। এছাড়া, ফ্রান্সের সেবা মুলক অর্থনৈতিক স্বচ্ছল এরিয়া হিসেবে ভার্সাইর সুনাম রয়েছে। ভার্সাইয়ে যেভাবে আসতে পারবেন : প্যারিস অস্টারলিজ হতে ট্রেন লাইন আরইআর “সি” যোগে ভার্সাই শাঁতো রিভঘোশ স্টেশনে নামতে হবে। প্যারিস মনপারনাস হতে ট্রেন লাইন “এন” যোগে ভার্সাই শন্তির স্টেশনে নামতে হবে। প্যারিস সেন্ট লেজার হতে লাইন “এল” যোগে ভার্সাই রিভদ্রোয়াত স্টেশনে নামতে হবে। যেকোন স্হান হতে অটো বাস, ট্যাক্সি যোগেও ভার্সাইয়ে আসতে পারবেন। প্যারিসের জিরো পয়েন্ট গার দ্যু নর্দ হতে ভার্সাইয়ে আসতে সময় লাগবে মাত্র ২০ থেকে ৪০ মিনিট। আমি বেশ কয়েক বার শাঁতো দ্যু ভার্সাই ঘুরে দেখেছি। যতই দেখি, ততই সুন্দর লাগে। ভার্সাই অঞ্চলের লোকজন খুবই ভদ্র ও উদার মনের অধিকারী। ফ্রান্সে প্রথমে আসার পর আমার সহোদর (ছোট ভাই) সুয়েব আমাকে ভার্সাই ঘুরে দেখিয়েছিল। পরবর্তীতে স্হায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ লাভের পর “অফিস ফঁসে দ্যু লইমিগ্রাসিও এ দ্যু লইন্টারগেছিও” (অফিই) কর্তৃক বাধ্যতামূলক ফরাসী ভাষা কোর্স এবং “ফ্রান্সের কর্মসংস্থান বিভাগ” কর্তৃক পেশাগত দুটি ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছি এই ভার্সাই শহরে। তাই খুবই অল্প সময়ে প্রিয় জন্ম স্হান সিলেটের মতো অনেক চেনা, জানা হয়ে গেছে ভার্সাই। জয়তু ভার্সাই।