পয়লা বৈশাখ ও আমাদের ঐতিহ্য

    1
    303

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,এপ্রিল,লুৎফুর রহমান তোফায়েলঃ পঞ্জিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিল আরেকটি বছর। আমরা অতিক্রম করলাম মহাকালের একটি ক্ষুদ্র অধ্যায়। বাংলা দিনঞ্জিকার পাতা থেকে খসে পড়ল ১৪২১ সন। পুরাতন সকল জীর্ণতাকে ঝেড়ে মুছে নতুন উদ্যমে জেগে উঠার আহ্বান নিয়ে উপস্থিত হলো ১৪২২ বঙ্গাব্দ।

    একবিংশ শতকের তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই সময়েও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন কৃষি নির্ভর। গ্রামীণ সমাজ অধ্যুষিত এদেশে ঘুরেফিরে বাংলা সন নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে। বাংলা বর্ষপঞ্জি এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, লোকজীবন, সংস্কৃতি এবং কৃষিজ অর্থনীতির সাথে অতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাই সামগ্রিক দিক বিবেচনায় আমাদের জন্য এই সনের গুরুত্বও অনেক।

    বাংলা সন প্রবর্তনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, স¤্রাট আকবরের আমলে ‘সুবা-এ বাংলা’ খ্যাত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা মোগল শাসনের আওতাভুক্ত হয়। তখন সাধারণ প্রজাদের কাছ থেকে ফসলের মাধ্যমে খাজনা আদায় করা হত। সেকালের রাজকীয় সন ছিল হিজরি। যা ছিল চন্দ্র ভিত্তিক। চান্দ্র বছর ৩৬৫ দিনের না হয়ে ৩৫৪ দিনের হয়ে থাকে। ফলে চন্দ্র ভিত্তিক আরবি মাস বছরের সৌর ভিত্তিক ঋতুর সাথে সুনির্দিষ্ট সামঞ্জস্য বহন করে না। তাই প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় সম্ভব হতো না। ফলে স¤্রাট আকবর একটি সৌর ভিত্তিক সন প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তখন স¤্রাট আকবরের নির্দেশে প্রচলিত হিজরি সনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাজ জ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী ৯৯৮ হিজরি, মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সন উদ্ভাবন করেন। কৃষিনির্ভর অত্রাঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে উদ্ভাবিত বলে এটি ‘ফসলি সন’ নামে অভিহিত হতো। বাংলার জন্য উদ্ভাবিত বলে পরবর্তী পর্যায়ে তা ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিত হয়।

    বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতিতে পয়লা বৈশাখের স্থান সবার শীর্ষে। এর সাথে জড়িত আছে এদেশের মানুষের প্রবল ভাবাবেগ। রয়েছে শেকড়ের টান। দিনটি এলে বাংলা ভাষাভাষী বা বাংলাদেশীদের মধ্যে জাগ্রত হয় নিজস্ব স্বকীয়তা, সংস্কৃতির শিক্ষার। স্বাধীন জাতি সত্ত্বার আত্মপরিচয়ে গর্বিত হয় সবাই। স্বাধীন জাতি হিসেবে নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, দেশপ্রেমের টান থেকে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এদিনকে বছরের অন্যান্য দিন থেকে আলাদাভাবে উদযাপন-বরণ করে থাকে। তবে বর্তমান সময়ে বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে যে আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয় তা আমাদের সেই চেতনার সাথে অনেকটা অসামঞ্জস্যশীল। ঐদিন বর্ষবরণের নামে বিকৃত সংস্কৃতির মহড়া দেখা যায় সর্বত্র। তাতে ঐতিহ্যের মূলে যাওয়ার চেয়ে ঐতিহ্যকে অপমানিত করার লজ্জায় পড়তে হয় বিবেকবান মানুষদের। হাল আমলে বৈশাখ বরণের এ মহাযজ্ঞ যেন পুরোটাই একটা উম্মাদনা।

    এ দেশের মানুষ আবহমান কাল ধরে যে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লালন করে আসছে, সে রীতির সঙ্গে বর্তমান বৈশাখ বরণের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্তমান ফ্যাশনের পান্তা-ইলিশ খাওয়া বাংলার আবহমান কৃষ্টির কোনো ধারাবাহিকতা নয়। যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ উৎসবের জন্ম, যে স্বাতন্ত্র্য আর স্বকীয়তায় বৈশাখ বরণ উজ্জ্বল ও অনন্য তাকেই যদি ছেটে ফেলা হয় তবে এ আয়োজনের প্রয়োজনটা আর কী? পয়লা বৈশাখ উদযাপন বাংলার গৌরবান্বিত অতীতকে সামনে এনে এ প্রজন্মকে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলায় কী অবদান রাখছে, বাংলা ভাষা আর বাংলা সংস্কৃতিকে এ প্রজন্ম কতটুকু ভালোবাসছে, কতটুকু প্রাণে ধারণ করছে? এটিই এখন ভাবার বিষয়।

    বৈশাখ উদযাপনকে প্রাণের টানের উৎসব, নাড়ির উৎসব বলা হলেও নতুন প্রজন্মের কাছে বৈশাখ অথবা বাংলা কোনোটাই খুব প্রাণের হয়ে উঠছে না। বৈশাখ বরণকে তারা আবহমান বাংলার ধারা, নিজস্ব কৃষ্টি ঐতিহ্য হিসেবে দেখছে না। তারা এটাকে এক ধরণের আনন্দ উল্লাস ও একটা দিন একটু হৈচৈ করে কাটানো মনে করে। বাংলাকে তারা প্রাণের ভেতরে ধারণ করতে পারছে না। বাংলা আমার এ মাটির, বৈশাখ আমার স্বকীয়তা, আমার অহংকার; এ বোধ তাদের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছে না। বাংলা সনের প্রথম দিনে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি কিংবা একতারা-দুতারা, ঢোল-তবলার চিত্রাঙ্কিত ফতোয়া-পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়ানো। বাঘ, ভাল্লুক, পেঁচার মুখ নিয়ে শোভাযাত্রা বা র‌্যালি, সবাই মিলে পান্তা খাওয়া, গান বাজনা, হইহুল্লুড় করে সময় কাটানো; এসব বর্ষবরণের কোনো কর্মসূচি হতে পারে না। কারণ যারা এসব কর্মসূচি করে থাকে কার্যত: এরা সারা বছর বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে কাটায়। ভিনদেশি সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে বেড়ায়। নিজের জাতি সত্ত্বার প্রতি তাদের কোনো অনুরাগ-ভালোবাসা লক্ষ করা যায় না। এরা পয়লা বৈশাখকে শুধু আনন্দ-উৎসবের একটি উপলক্ষ হিসেবে দেখে। বস্তুত: পহেলা বৈশাখের সাথে জড়িত আছে আমাদের গৌরময় ইতিহাস-ঐতিহ্য।

    বছরের প্রথম দিনে ফূর্তি করতে দোষের কিছু নেই। দোষ তখনই ঘটে যখন তার সাথে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য নামক ডাহা মিথ্যা কথাটি বানোয়াট চিত্রের সাহায্যে তুলে ধরা হয়। এদিন শহরের বিভিন্ন স্থানে চলে কনসার্টের নামে তারুণ্যের বাঁধ ভাঙা উম্মাদনা।

    প্রশ্ন হল, বর্ষবরণের তাৎপর্যের সাথে এ জাতীয় উম্মাদনার যৌক্তিকতা কতটুকু? শুধু তাই নয়, পয়লা বৈশাখে র‌্যালি বা শুভাযাত্রায় প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, গেরুয়া রঙের পোশাকে, চন্দন তিলক পরা তরুণ-তরুণীরা খোল করতাল আর ঢাক ঢোল পিটিয়ে শোরগোল করছে। রাখী-বন্ধন, শাখা সিঁদুর, এগুলো তো রয়েছেই। এগুলো কোন সংস্কৃতি? বর্ষবরণের সাথেই বা এর সম্পর্ক কী?

    বর্ষবরণের জন্য নির্মল নিষ্কলুষ কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানের বিরোধীতা করা যাবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে দেশীয় ও ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো পরিহার করে দেশীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের লালন ও বিকাশ সাধনে কাজ করতে হবে।