পবিত্র ঈদুল আদ্বহা:এক মহান ত্যাগের স্মারক

    0
    218

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২২সেপ্টেম্বর,এহসান বিন মুজাহিরঃ আগামি ২৫ সেপ্টেম্বর (দশ জিলহজ) শুক্রবার, সারা দেশে পবিত্র ঈদুল আজহা (আদ্বহা) পালিত হবে। মুসলিম মিল্লাতের ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম একটি উৎসব ঈদুল আজহা (আদ্বহা)। ঈদুল আজহা (আদ্বহা) তথা কোরবানির ঈদ মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, আত্মত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মহিমায় মহিমান্মিত। হজরত ইবরাহিম (আঃ) এবং তার প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) সেদিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশ পালন ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আত্মত্যাগের এক অনুপম নজির স্থাপন করেছিলেন।

    মানব ইতিহাসে চির স্মরণীয় সেই ত্যাগের ঘটনার স্মারক পবিত্র ঈদুল আজহা (আদ্বহা)। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট   আনন্দ উৎসবের দিন। তারা এ দিনে আনন্দ ও আমোদ প্রমোদে মেতে উঠে। তেমনি মুসলিম উম্মাহর জন্য ও রয়েছে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত আনন্দ উৎসবের  দিন। নির্ধারিত এ তারিখে মুসলিম জাতি ঈদ  (আনন্দ) উদযাপন করে। মাহে জিলহজ্জের দশম তারিখে মুসলিম উম্মাহ পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন করবে।ঈদ শুধু আনন্দই নয়, বরং আমাদের জন্য অন্যতম একটি ইবাদতও।

    আল্লাহ তাআলার প্রতি আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য, কি পরিমাণ ত্যাগ ও নিষ্ঠা দাবী করে তাঁর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ রয়েছে হজরত ইবরাহিম (আঃ) এর আত্ম নিবেদনের এই অভূতপূর্ব ঘটনার মধ্যে। মহান আল্লাহ পাকের নির্দেশে এবং তারই সন্তুষ্টি সাধনের জন্য নিজ পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) কে কুরবানি করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন হজরত ইবরাহিম (আঃ)। হজরত ইসমাইল (আঃ) ও একই উদ্দেশ্যে পিতার ক্ষুরধার ছুরির নীচে স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে নিজের গলা পেতে দিয়েছিলেন। আল্লাহ রহমানুর রাহিম পিতা-পুত্রের এই আনুগত্য,ত্যাগ, আত্মসমর্পন চিত্ততা, ভক্তি ও আন্তরিক পরিচয়ে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় রক্ষা পেয়েছিল হযরত ইসমাইল (আঃ) এর জীবন। সেদিন সৃষ্টি হয়েছিল আল্লাহ ভক্ত পিতা-পুত্রের আত্মত্যাগের অসাধারন দৃষ্টান্ত।

    এই ঘটনাকে মানব জাতীর সামনে আদর্শ হিসেবে চির জাগরূক করে রাখার জন্যই আল্লাহ পাকের তরফ থেকে সেদিন কোরবানীর বিধান প্রর্বতিত হয়েছিল। সেই থেকে এই বিধান অব্যাহত রয়েছে এখন পর্যন্ত যা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

    কোরবানির ঈদ আমাদেরকে স্মরণ করে দেয় হজরত ইবরাহিম (আ.)  সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের স্মৃতি ও ইসমাঈরল (আ:) এর আনুগত্যের ঐতিহাসিক ঘটনা।  আজ বক্ষমান নিবন্ধে কোরবানির তাৎপর্য ও মাসাইল সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস করলাম।

    কোরবানি শব্দের বিশেষণ: কোরবানির শব্দটি আরবী, এর উৎপত্তি হয়েছে ‘কুরবানুন’ মাসদার থেকে। কুরবানি শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়। কোরবানি শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে নৈকট্য, সান্নিধ্য, আত্মত্যাগ, জবেহ, রক্তপাত ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়,মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তোষ লাভের আশায় নির্ধারিত তারিখের মধ্যে সু-নির্দিষ্ট নিয়মে হালাল কোন পশু আল্লাহর নামে জবেহ করা। আবার  এভাবেও বলা যেতে পারে যে, প্রত্যেক এমন নেক আমল বা ত্যাগ, যার মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করা সম্ভবপর হয়।

    কোরবানি নতুন কোন প্রথা নয়, বরং এটা আদিকাল থেকে চলে আসছে। হযরত আদম (আ:) এর যুগে কোরবানির সুচনা হয়েছিল। আদম (আ:) এর সন্তান হাবিল কাবিলের মধ্যে বিবাহ-শাদী নিয়ে যখন মতানৈক্য দেখা দিল তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ইখলাসের সঙ্গে হালাল পশু কোরবানি করার নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন তোমাদের মধ্যে যার কোরবানি আমার নিকট কবুল হবে তার নিকট মেয়ে বিবাহ দেয়া হবে। হাবিল এবং কাবিল কোরবানির নির্দেশ পেয়ে কোরবানি করল। হাবিলের কোরবানি আল্লাহর কাছে  কবুল হল কিন্তু সহিহ এখলাসের অভাবে কাবিলের  কোরবানি কবুল হলো না। কাবিলের কোরবানি কবুল না হওয়ার কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে হাবিলকে বলল আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব।

    এ প্রসঙ্গে মহান আলাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,‘হে নবী (ঐশী সংবাদ দাতা) আপনি তাদের নিকট যথাযথভাবে আদম (আ:) এর পুত্রদ্বয়ের কথা আলোচনা করেন, যখন তারা মহান প্রতিপালকের নিকট  তাদের কুরবানিকে পেশ করল, তখন একজনের কবুল হল অন্যজনের হলো না। যার কোরবানি কবুল হলো না-সে ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যজনকে বলল আমি তোমাকে খুন তথা হত্যা করে ফেলবো। মহান পালনকর্তা একমাত্র মুত্তাকীদের (আল্লাহর প্রতি পুর্ন আস্থাকারী) কোরবানি কবুল করেন’। (সূরা মায়িদা:২৭)

    আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে বিভিন্ন রকমের বস্তু দ্বারা পরীক্ষা করে থাকেন। কখনো বিপদাপদের মাধ্যমে, কখনো ধন-সম্পদ বিনষ্টের মাধ্যমে, আবার কখনো শারীরিক অসুস্থতা দিয়ে। পরীক্ষা থেকে বাদ যাননি নবী-রাসূলগণও। নবী-রাসূলগণকেও আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা করেছেন। বিশেষ করে আমাদের জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ:) অসংখ্য পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। তন্মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণীয়  স্রষ্টার আদেশে স্বীয় সন্তানের কোরবানি।

    নিম্নে কোরবানির ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটসহ মুল ঘটনা উপস্থাপন করা হলো:  প্রথমে হযরত ইবরাহিম (আ:) এর কোন সন্তান ছিল না তাই তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বললেন ‘হে আল্লাহ! আমাকে  আপনি নেককার সন্তান দান করেন। তাঁর এ দুয়া  মহান  রাব্বুল্ আলামিনের কাছে কবুল হয় এবং তিনি তাঁকে  এক পুত্রের সু-সংবাদ দিলেন। ইবরাহিম (আ:) একদিন স্বপ্নে দেখলেন যে  মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাঁর কলিজার টুকরা পুত্র সন্তানকে  আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি দেয়ার জন্য। কোন কোন রেওয়াত থেকে জানা যায় যে, এই  স্বপ্ন ইবরাহিম (আ:) কে পরপর তিনদিন দেখানো হয় ।

    ইবরাহিম (আ: স্বপ্নের আধ্যমে এ নির্দেশ  পেয়ে  চিন্তিত হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন ইসমাঈল কি মেনে নিবে। সে কি আল্লাহর রাস্তায় জীবন দিতে রাজি হবে। তিনি  তার ছেলের কাছে গেলেন এবং বললেন আমি স্বপ্নের মাধ্যমে তোমাকে কুরবানি করার  নির্দেশ পেয়েছি তোমার কি মতামত ? তিনি  সাথে সাথে বলে উঠলেন, আব্বা আপনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নির্দেশ  পেয়েছেন তা বাস্তবায়ন করেন। ইনশাল্লাহ আমাকে আনুগত্য  ও ধৈর্যশীলদের অন্তভূক্ত পাবেন। দেশে একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদ রয়েছে যে, ‘বাপে বেটা, গাছে গোঠা’ অর্থাৎ ইসমাঈল (আ:) তিনি তো  ইবরাহিমেরই পুত্র এবং যোগ্য উত্তরসূরী ।

    পুত্র ইসমাইল (আ:) এর  মুখ থেকে প্রাণভরা কথা শুনে তিনি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তাকে কোরবানি করার জন্য  ময়দানে নিয়ে গেলেন। ইসমাাঈল (আ:) এর  হাত, পা, বেঁধে জমিনে শুইয়ে দিলেন । ধারালো চাকু তাঁর গলায় চালাতে লাগলেন  কিন্তু আল্লাহর কি অপার মহিমা ছুরি তথা চাকু দ্বারা গলা কাটবে তো দূরের কথা তার গলায় দাগও বসাতে পারেনি। ইবরাহিম (আ:) নতুন আরেকটি ছুরি হাতে নিলেন এবং পুত্রের গলায় ছুরি চালাতে লাগলেন তখন গায়েবী(অদৃশ্য)ভাবে একটি আওয়াজ তার কানে পৌঁছলো, হে ইবরাহিম তুমি মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ  হয়েছো, তোমার কলিজার টুকরা সন্তানকে আর কষ্ট দিও না ,এবার তাকে ছেড়ে দাও।  তোমার কোরবানি হয়ে গেছে। পুত্রের বদলে তুমি একটি তর-তাজা দুম্বা  কুরবানি করো। তখন ইবরাহিম আ: একটি দুম্বা কুরবানি করে আল্লাহর নির্দেশ পালন করলেন।

    হযরত ইবরাহিম (আ:) ইসমাইল (আ:) কে কোরবানি করতে গিয়ে শয়তান অনেক কুমন্ত্রণা ও প্রতারণা দেয়ার  প্রাণপণ  প্রচেষ্টা করছিলো কিন্তু খলিলুল্লাহ শয়তানের সব প্ররোচনাকে পাড়ি দিয়ে মহান রবের নির্দেশ পালনে মনযোগী হলেন ।

    ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত তিনি বললেন যখন  ইবরাহিম ছুরি চালালেন তখন জিবরাইল আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, না জানি আমি পৌঁছার আগেই জবাই কাজ শেষ হয়ে যায় কিনা তাই তিনি জোরে জোরে আ্ল্লাহু আকবারের ধ্বনি  বলে আসছিলেন, আর এ তাকবিরের আওয়াজ ইবরাহিম (আ:) এর কানে পৌছলো তিনি উপরের দিকে তাকালেন এবং বুঝতে পারলেন যে, জিবরাইল আঃ তাকবির ধ্বনি দিয়ে আসতেছেন তখন তিনি বলে উঠলেন ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার  আল্লাহু আকবার’ আর এই তাকবীর শুনার পর ইসমাঈল (আ:) পরবর্তী লাইন ‘ওয়ালিল্লাহিল হামদ’বলে উঠলেন। (তাফসিরে মাযহারি)

    পিতা পুত্রের এই মহা আত্মত্যাগ আজও মুসলিম জাতি তথা আমাদেরকে  প্রেরণা যোগায়। এই অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগের ইতিহাসকে স্মরণ রাখার জন্য আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মোহাম্মদির উপর কোরবানিকে ওয়াজিব করেছেন ।

    কোরবানির তাৎপর্য ও ফজিলত: কুরবানি একটি গুরুত্বপুর্ণ ইবাদত এবং তার ফজিলত অপরিসীম । সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের উপর কুরবানি ওয়াজিব ।  এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন কুরআন কারিমে ইরশাদ করেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি যাতে তাঁরা হালাল পশু জবেহ করার সময় আল্লাহর  নাম উচ্চারণ  করে। (সূরা হজ্জ্ব:৩৪)

    একদিন  হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রা: রাসুল (দঃ) এর নিকট জিজ্ঞাসা করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোরবানি কি ? তখন উত্তরে রাসুল (দঃ) ইরশাদ করলেন কোরবানি হচ্ছে ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ:এর জীবনাদর্শ ’সাহাবী  পুনরায়  জিজ্ঞাসা করলেন কোরবানির ফজিলত কি ? রাসুল (দঃ) বললেন, ‘পশুর পশমের পরিবর্তে একেকটি  করে নেকি দেয়া হয়’। -মিশকাত শরিফ: ১/১২৯

    রাসুল (দঃ) ইরশাদ করেন, কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার  আগেই কোরবানি দাতার কোরবানি আল্লাহর  দরবারে কবুল হয়ে যায় এবং তাঁর  অতীতের সকল গুনাহ মোচন করে দেয়া হয় । -তিরমিযি শরীফ । তিরমিযি শরিফ: ১/১৮০

    মহানবী (দঃ) আরো ইরশাদ করেন,‘তোমরা মোটা তাজা পশু দেখে কোরবানি কর, কারণ এ পশুই  পুলসিরাতের বাহক হবে ।-মুসলিম শরিফ

    বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (দঃ) পবিত্র মদিনায় দশ বৎসর জীবন-যাপন করেছেন প্রত্যেক বছরই তিনি পশু কোরবানি করেছেন ।- তিরমিযি শরীফ :১/১৮৯

    হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (দঃ) ইরশাদ করেন,‘কোরবানির দিন আল্লাহর নিকট কুরবানি অপেক্ষা উত্তম  কোন আমল আর নেই’।  মিশকাত শরিফ

    বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, নবী করীম (দঃ) ইরশাদ করেন ,‘সামর্থ্য থাকা স্বত্ত্বেও  যে ব্যক্তি কোরবানির দিন কোরবানি করে না, সে যেন ইদুল আজহার দিন ঈদগাহের ময়দানের কাছে না যায়’। (-ইবনে মাজাহ শরিফ)

    লেখক:সিনিয়র যুগ্ন আহব্বায়ক, মৌলভীবাজার অনলাইন প্রেসক্লাব,নির্বাহী সম্পাদক পাক্ষিক মঙ্গলবার্তা