পঁচিশ ও ছাব্বিশে মার্চ কী কান্ড ? কী ঘটে যায় !

    1
    505

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২৫মার্চ,গোলাম দাস্তগির লিসানীঃ আজকের রাতটা নিয়ে, কালকের দিনটা নিয়ে এই লেখাটা হয়ত আসতই না, আমি কী করে যেন টেবিলের উপর পেলাম ‘একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বক্তৃতা ও বিবৃতি’ বইটা। কী করে যেন সেটা পড়া শুরু করলাম। ছিল আগেই। টুকটাক পড়া। এবং তারপর একটু কথা হল ফোনে।

    আজকের রাতটা, কালকের দিনটা, আসলে শুধু স্মরণের রাত ও দিন।

    এই আজকের রাতটার জন্য, এর পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়গুলো শুরু হয় সেজন্য, যাঁরা নিজের বাবা-মা কে ঝুঁকিতে ফেলে, পরিবারকে পেছনে ফেলে, নিজের দেশকে পেছনে ফেলে, নিজের প্রাণবন্ত কৈশোরকে তুচ্ছ করে অস্ত্র নিয়ে নেমে গিয়েছিলেন মাঠে ময়দানে… বাথরুমের তলা দিয়ে মাথায় পাটখড়ির বোঝার ভিতরে অস্ত্র নিয়ে যাঁরা দৌড়ে দিয়েছিলেন, যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, যাঁরা আপনহারা হয়েছিলেন- এই রাতটা শুধু তাদের রাত।

    তাদেরই একজনকে একটু আগে দেখলাম। এই পাঁচ মিনিট আগে। কাঁথা মুড়ি দেয় শুয়ে আছেন। আমার বাবা কখনো মুক্তিযুদ্ধের কথা সহজে আমাদের বলেন না। এমনকি জটিলেও বলেন না। কেন বলেন না, তা বুঝি। বলেন না, কারণ, এই বলে বাহাদুরি নেয়ার জন্য তারা কাজটা করেননি। বীর সাজার জন্য তাঁরা একাত্তরের জন্ম দেননি, বাংলাদেশের জন্ম দেননি। বরং তাঁরা প্রকৃতই বীর। যে প্রকৃতই বীর, তাকে বীর সাজতে হয় না।

    প্রকান্ড রাগ হয়, হেলেদুলে ভিতরে ভিতরে বটগাছ হয়ে যায়, যখন শুনি, “একবার মুক্তিযোদ্ধা সব সময়ের মুক্তিযোদ্ধা নয়। একবার রাজাকার সব সময়ের রাজাকার।”

    একবার মুক্তিযোদ্ধা সব সময়েই মুক্তিযোদ্ধা! কে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবে আর কে পারবে না, তা ওই একটা বছরে, মাত্র নয়টা মাসে নির্ধারিত হয়ে গেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, তাদের বাসরসঙ্গী- এইসব পক্ষের সাথে যে কী পরিমাণ নিশ্চয়তা ছিল, কী পরিমাণ ভোগ ও আরাম ও সহায়তা ছিল, তা বর্ণনাতীত। তা আজকের মানুষরা বুঝবে না। যে ভোগের, সুবিধার, আরামের বীজ নিজের ভিতর থেকে শেকড়সুদ্ধ উপড়ে বের করে পরম অনিশ্চয়তার দিকে ওই নয় মাসের কোন এক দিবসে বা রজনীতে রওনা দিতে পেরেছিল, সে ওই মুহূর্তে মহামানবে পরিণত হয়েছে।

    নয়মাস চলে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগও চলে গেছে, মুক্তিযোদ্ধা-শিপ ক্যান্সেল হওয়ার সুযোগও সেইসাথেই চলে গেছে।

    আজকের রাতটা এবং আজকের দিনটা তাদের রাত এবং তাদের দিন।

    কী পরিমাণ অমানুষিক যন্ত্রণা ও বঞ্চনার ভিতর দিয়ে তাঁরা গেছেন! তাঁরা হয়ে গেছেন পশুশক্তির মুখে “ভারতীয় চর”, “ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী”, “ইসলামের শত্রু”, “দেশদ্রোহী”, “গন্ডগোলের উৎস”!

    এই লোকটাকে, এই লোকগুলোকে কোনদিন যদি হাঁটু গেড়ে বসে বলতে পারতাম, তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না, তাও কিছু হতো না। এবং এদের বেশিরভাগই তা উড়িয়ে দিয়ে সামনে চেয়ে থাকতো। যেন কিছুই হয়নি, যেন তারা কিছুই না।

    আজরাত ওই নারীদের স্মরণের রাত, যারা রোকেয়া হলে ছিল। ওই রিকশাশ্রমিকদের স্মরণের রাত, যারা পথে নিজের রিকশায় শুয়ে ছিল, ওই পুলিশদের স্মরণের রাত, যারা রাজারবাগের পুলিশলাইনে ছিল অথবা পলাশীর ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যানদের।

    আজকের রাত কিন্তু পাকিস্তানী বনাম বাংলাদেশির বা বাঙালির রাতই শুধু নয়।
    আজকের রাত ভোগ-দখল-দাসত্ব বনাম মানবতা-মুক্তির রাত।

    রক্তের উপর দাঁড়ানো দেশে আমরা জন্ম নিয়েছি, ধর্ষণের যন্ত্রণা দিয়ে আমাদের উত্থান, পঁচা লাশে বৈঠা দিয়ে যে নাকচাপা নৌযান বাংলাদেশের নদীগুলোতে চলেছিল- সেই দেশে আমরা ফাও ফতুল্লা জন্ম গ্রহণ করেছি।

    এরপর সেই রক্তকে আমরা অস্বীকার করেছি, সেই ধর্ষণকে অস্বীকার করেছি, সেই লাশগুলোকে অস্বীকার করেছি, সেই শিশু-কিশোর-যুবা-বৃদ্ধকেও অস্বীকার করেছি যারা এই দেশকে জন্ম দিয়েছেন।

    আমরা এই দেশের প্রতিটা বিষয়কে অস্বীকার করেছি- এদেশের মানুষকে, এদেশের পানিকে, এদেশের নদীকে, এদেশের বাতাসকে, এদেশের চাষের জমিকে, এদেশের মানুষের রক্তে ঘুরতে থাকা প্রতিটা কণাকে আমরা প্রতিনিয়ত রাঘব বোয়ালের মত ঠুকরে চলেছি। খেতে না পেরে ক্ষত করেছি। খেতে পেয়ে গিলে খেয়েছি। অন্যকে কামড়াতে দেখে দূরে গিয়ে হুইস্কি গিলে পার্কা গায়ে দিয়েছি। সর্বদুষণে দুষ্ট করেছি। সর্ববিষে নীল করে লীন করেছি।

    কূটনীতির টেবিলে পাকিস্তানের মানচিত্র তৈরি হয়েছিল, বাংলার মানচিত্র কেউ তৈরি করে দিয়ে যায়নি। অদূষিত অকলূষিত পবিত্র রক্ত অকারণে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলার মানচিত্র তৈরি হয়েছে। বাংলাকে অনৈতিকতার আখড়া আমরা করেছি, সর্বনীতিবিবর্জিততায় সাফল্য- এই সূত্র বাংলায় আমরা গড়েছি, বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার তরু বাংলার ফল পূণ্য না হয়ে বিষাক্ত দূষিত হয়েছে- তা জন্মগত নয়, আমরা করেছি। এই দোষ আমাদের, বাংলার জন্মের নয়। বাংলার জন্ম পবিত্র। বাংলার জন্ম নিষ্কলুষ। বাংলার জন্ম মহান, মহত্তম।

    কেননা, মানব-রক্তের চেয়ে পবিত্র মহান ও দামী দ্বিতীয় কোন তরল নেই। আর কোন কঠিন-তরল-বায়বীয় বস্তুর মূল্য এর সমান নেই। সেই রক্তের ঋণ শোধ কখনোই শুধু বিচার দিয়ে হবে না, বরং বিচার দিয়ে খুবই সামান্য কিন্তু অপরিহার্য অংশ আদায় হবে। সেই রক্তের ঋণ শোধের উপায় মাত্র একটা- আর তা হল সার্বিক নৈতিকতা। গুড় ওয়ালা গুড়ে সার দিবে না, এটা নিশ্চিত করা ভবিষ্যত গুড়ওয়ালার জন্য… এভাবেই সবকিছুতে। একটা যানবাহনে নারীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হবে না। যদি নেয়া হয়, তা হতে দেয়া হবে না- সাফল্য এখানেই।

    রক্তমূল্য যেমন সর্ব্বোচ্চ মূল্য, রক্তঋণও সর্ব্বোচ্চ ঋণ- আর এই ঋণ শোধের একমাত্র পথ বিশুদ্ধ নৈতিক সহাবস্থানিক শিক্ষা- যেখানে কেউ কাউকে দাস করবে না, কেউ কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, আর যদি করেও, তবে সাথে সাথে তার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে।

    রক্তঋণ শোধের একমাত্র উপায় ভবিষ্যতের মানুষ যেন বিশুদ্ধ রক্ত বহন করতে পারে তা নিশ্চিত করা।
    বাংলা কোন ভাগাড় নয়, বাংলা কোন ভাড়ারও নয়। না, বাংলা ডুবন্ত তরী নয়। বাংলা আগুন ধরা ঘর নয়। বাংলা দূষণের শেষ স্থান নয়। বাংলা যে তা নয়, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করাই মহান মুক্তিযুদ্ধ, এর শহীদ, এর বীরাঙ্গনা, এর আহত. এর মুক্তিযোদ্ধাদের মহত্তম ত্যাগের একমাত্র প্রতিদান।

    বিশুদ্ধ রক্তের মূল্যে বাংলা ক্রীত হয়েছে, এদেশের মানুষের নৈতিকতায় ও শরীরে অশুদ্ধ রক্ত যেন বাহিত না হয়- এটাই আজকের রাত ও কালকের দিনের মূল সূত্র হোক।