নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে টিআইবি’র ৮ দফা সুপারিশ

    0
    226

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,১২মার্চ,এম,এ কাদেরঃ  নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের পথে দুর্নীতিকে অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে এ থেকে উত্তরণে আট দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ১২ মার্চ সকালে ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে “নারীর অভিজ্ঞতায় দুর্নীতি: বাংলাদেশের দুইটি ইউনিয়নের চিত্র” শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি নারীর ওপর দুর্নীতির প্রভাব নির্ণয়ে বহুমাত্রিক গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করে। সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন শাহজাদা এম আকরাম, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার; দিপু রায়, প্রোগ্রাম ম্যানেজার; শাম্মী লায়লা ইসলাম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও ফাতেমা আফরোজ, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি।

    অনুষ্ঠানে আরোও উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।

    এ গবেষণায় গুণগত পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে এবং ২০১৩ সালের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জামালপুর ও গাজীপুর জেলার দুইটি ইউনিয়ন থেকে তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুর্নীতির অভিজ্ঞতা লাভ করে। এর মধ্যে দুর্নীতির শিকার, সংঘটক ও মাধ্যম হিসেবে নারীর সাথে দুর্নীতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা (পুলিশ), এনজিও, বিচারিক সেবা, ভূমি, ব্যাংক, পল্লি বিদ্যুৎসহ ইত্যাদি সেবাখাতে সেবা নিতে গিয়ে নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত অর্থ জোর করে আদায়, প্রতারণা, স্বজনপ্রীতি ও দায়িত্বে অবহেলার মত দুর্নীতির শিকার হয়ে থাকে নারীরা।

    এছাড়া এসব খাতে নারীদের জন্য বিশেষায়িত সেবা, যেমন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ভিজিডি/ ভিজিএফ, মাটি কাটার কাজ, নারী নির্যাতন মামলা দায়ের, উপবৃত্তি ইত্যাদি গ্রহণ করার সময় দুর্নীতির শিকার হয় নারী।

    ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য হিসেবে উন্নয়ন বরাদ্দ, বাজেট প্রণয়ন ও সালিশ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, এবং উন্নয়ন কর্মসূচি তদারকিতে তাদের অংশগ্রহণে বাধা দিতে দেখা যায়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিষদের পুরুষ সদস্যদের দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ারও উদাহরণ রয়েছে।

    সেইসাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী কোটায় নিয়োগ, পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে টার্গেট পূরণের জন্য রোগী কেনা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অধীনে গাছ পাহারা দেওয়ার কাজ, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সেবা নিতে গিয়েও নারীদের দুর্নীতির শিকার হতে হয়।

    অন্যদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানকারীর অবস্থানে থেকে নারীদের একটি অংশের দুর্নীতিতে সংঘটক হিসেবে জড়িত থাকার চিত্র পাওয়া যায় গবেষণায়। এছাড়া গবেষণা এলাকায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির অংশ হিসেবে নারীদের অনৈতিকভাবে ব্যবহার করার চিত্র পাওয়া যায়। ইউনিয়ন পরিষদে উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে খালি চেকে নারী সদস্যদের স্বাক্ষর আদায় করা হয় আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে।

    পারিবারিক পর্যায়ে নারীকে ব্যবহার করে এনজিও’র ক্ষুদ্রঋণ, ব্যাংক ঋণ বা দাদনের টাকা আত্মসাৎ করার উদাহরণ রয়েছে। এছাড়া ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে, উপজেলা স্বাস্থ্য কার্যালয়ে, উপজেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে এবং ব্যাংকে সংশ্লিষ্ট নারী কর্মীর মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করা হয়, যার প্রতিটি ক্ষেত্রে এসব অর্থ আদায় দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ফলাফল।

    প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় নারীর ওপর দুর্নীতির প্রভাব বহুমাত্রিক। প্রথমত নারীর ওপর দুর্নীতির ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে প্রভাব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা যায় ডাক্তারের অবহেলার কারণে নারী রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া দুর্নীতির কারণে নারীদের শারীরিক ক্ষতি, যেমন ভুল চিকিৎসার কারণে জরায়ু কেটে ফেলা, ভুল জন্ম-নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি স্থাপন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়া উল্লেখযোগ্য।

    ঘুষ বা অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কারণে নারীর অতিরিক্ত ব্যয় হয় এবং তার নির্ধারিত প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয় (সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে প্রাপ্য)। এছাড়া দুর্নীতির কারণে তার প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। তবে অন্যদিকে দুর্নীতির ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়।

    এটি হয় নারী নিজে দুর্নীতি করার কারণে, যার ফলে হয় সে আর্থিকভাবে লাভবান হয় অথবা দুর্নীতির মাধ্যমে তার কাজ আদায় করে। দ্বিতীয়ত রয়েছে নারীর ওপর দুর্নীতির ক্ষতিকর সামাজিক প্রভাব। দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ফলে নারীরা দুর্নীতিকে স্বাভাবিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করে।

    ফলে সমাজে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হিসেবে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। তৃতীয়ত, দুর্নীতির আরেকটি নেতিবাচক প্রভাব হচ্ছে রাজনৈতিক। দুর্নীতির কারণে নারীর ক্ষমতায়ন ব্যাহত হয়, বিশেষ করে স্থানীয় সরকার খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পেছনে তাদের ক্ষমতায়নের যে উদ্দেশ্য তা ব্যাহত হয়।

    প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সুশাসনের ঘাটতির কারণে নারীর দুর্নীতির অভিজ্ঞতা হয়। গবেষণা এলাকায় সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি, অংশগ্রহণের ঘাটতি, এবং সর্বোপরি আইনের শাসনের ঘাটতি লক্ষণীয়।

    টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ফলে যারা দুর্নীতি করেন তারা বিচারের আওতায় আসেনা বা আসলেও সঠিক বিচার হয়না। সেটারই একধরণের প্রভাব নারীর ওপর পড়ে, ফলে নারী যে কেবল দুর্নীতির শিকার হচ্ছে তা নয় বরং সে দুর্নীতি মেনে নিচ্ছে, দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত হচ্ছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেরাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে।”

    অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “যারা সংখ্যালঘু নারী তারা দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক নানা পর্যায়ে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। নারী যে অবস্থানেই থাকুক না কেন তার অধিকারের সম্মানজনক স্বীকৃতি দিতে হবে।” তিনি আরোও বলেন, “ যারা ক্ষমতায় যান তারা ভুলে যান ক্ষমতার সাথে মর্যাদার সম্পর্কের কথা সেজন্যই ক্ষমতার অপব্যবহার হয়। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে ক্ষমতার সাথে মর্যাদার বিষয়টি সংযুক্ত করতে হবে।”

    নারীর ওপর দুর্নীতির প্রভাব নিয়ন্ত্রণে টিআইবি’র উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হল:- দুর্নীতির সাথে নারীদের সম্পৃক্ততা আরও ভালভাবে বোঝার জন্য, বিশেষকরে শহরাঞ্চলের চিত্র, দুর্নীতির সংঘটক হিসেবে নারীদের সম্পৃক্ততার কারণ, দুর্নীতির অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পার্থক্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে আরও বিস্তারিত গবেষণা করা; জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ ও এর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রণীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা কার্যকর করা।

    বিশেষ করে নারীর দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মক্ষেত্রসহ সকল ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা বিধান, আর্থ-সামাজিক কর্মকানডে নারীর পূর্ণ ও সম-অংশগ্রহণ, এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়ন করা; ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্যদের সমতাভিত্তিক ও আনুপাতিক কাজের পরিধি নির্দিষ্ট করা; প্রযোজ্য খাতে/ প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান স্টপ সেবা’র প্রচলন; যেসব প্রতিষ্ঠানে নারীরা সেবা নিতে যান সেসব প্রতিষ্ঠানের সেবা, বিশেষ করে নারীদের জন্য প্রদত্ত সেবা সম্পর্কে জেন্ডার সংবেদনশীল পদ্ধতিতে তথ্য প্রচার এবং নারীদের তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা; ইউনিয়ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য প্রদত্ত বিশেষ সেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তদারকি বাড়ানোর জোর সুপারিশ করে টিআইবি।