নবীগঞ্জে হিমেলের সাপের খামার:নতুন সম্ভবনা

    0
    223

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৮অক্টোবর,মতিউর রহমান মুন্না: নবীগঞ্জ উপজেলার বড় ভাকৈর ইউনিয়নের বাগাউড়া গ্রামের ওবায়দুর রহমান হিমেল নামের এক তরুন তার নিজ গ্রামেই গড়ে তুলেছেন একটি সাপের খামার। খামারের নাম দিয়েছেন ‘বেঙ্গল কোবরা ভেনম’।  দেশী কোবরা, শঙ্খীনি জাতের সাপ নিয়েই গড়ে তুলেছেন খামারটি। ২০/২৫টি সাপ নিয়ে খামারের কার্যক্রম শুরু করলেও এখন প্রায় শতাধিকের উপরে সাপ আছে তার খামারে। সাপের বিষ রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়ার কথা সরকার ঘোষণা করার পর অনুপ্রাণিত হয়ে হিমেল খামারটি গড়ে তোলেন। খামার থেকে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার বিষ উৎপাদন করা সম্ভব বলে তরুণ এই উদ্যোক্তা জানিয়েছেন এই প্রতিবেদককে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারি অনুমোদন না পাওয়া যায়। বিষ উৎপাদনসহ বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে পারছেন না তিনি।

    হিমেল বাগাউড়া গ্রামের স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুজাহিদুর রহমানের ছেলে। আর মাতার নাম জোবেদুন নাহার, একজন তিনি একজন গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড় হিমেল। হিমেল দীর্ঘ দিন ধরে স্থানীয় কাজির বাজারে আল-রায়হান নামের একটি ফার্মেসিতে ঔষধের ব্যবসা করে আসছেন।

    গতকাল সরজমিনে গেলে এক সাক্ষাতকালে হিমেল এ প্রতিবেদককে জানায়, সাপের খামার করা তার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন। খামার করতে প্রথমে তার মায়ের মত ছিল না। অজানা আশংকায় তার মা ছিলেন ভীত সন্তস্ত্র। হিমেল তার মাকে একবার গভীর রাতে এ্যানিমেল প্লানেট টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সাপের খামারের ডকুমেন্টারী দেখায়। তা দেখে হিমেলের মা আশ্বস্ত হলেও সহজাত স্বভাব সুলভ আচরণে সন্তানের অজানা আতঙ্কে তিনি সর্বদা শংকিত। কিন্তু তার পিতা বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন। এখন পরিবারে সবারই সহযোগিতা পাচ্ছেন বলে তিনি জানালেন।

    হিমেল ২০০৮ সালে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সাপের খামার সম্পর্কে নিবন্ধ পড়ে উৎসাহ বোধ করেন। ২০১৩ সালে আমাদের দেশে বাইরে থেকে জীবন রক্ষাকারী ঔষুধ তৈরীর জন্য ১৪ হাজার কোটি টাকার সাপের বিষ আমদানী করে এমন তথ্য জানার পর সাপের খামার করার চিন্তাটা মাথায় আসে। তখন সে বলে আমরাও পারি ঔষধ শিল্পের জন্য সাপের বিষ উৎপাদন করতে।

    এ সময় সাপ নিয়ে বিভিন্ন ডকুমেন্টারী ফিল্ম কিংবা ইন্টারনেটে ব্যাপক পড়াশুনা করে। খামার ব্যবস্থাপনা, বিষ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, সাপের প্রজনন, পরিচর্চা সম্পর্কে জানতে থাকে। পাহাড়ের সাপ সংগ্রহকারী সাপুড়েদের সাথে থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের চেষ্টা করে। পরবর্তীতে তার পিতাকে সঙ্গী করে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল কোবরা ভেনম’ নামে একটি বিষধর সাপের খামার গড়ে তোলেন।

    হিমেল আরো জানায়, প্রথমের দিকে গ্রামবাসী তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। সাপুড়ে, বেদে বলে ডাকতো। এ ও কথা শুনতে হয়েছে ‘শেষ পর্যন্ত সাপের ব্যবসা করতো হলো’। সেই সাথে ছিল কুসংস্কারের ভয়াল থাবা। কিন্তু এখন দেখেন সবাই তার সাথে। তাই সব সময়ই খামরের নিকটে থাকে উৎসুক জনতার ভীড়। খামার তৈরি একদিনে হয়নি। বেশ কাঠ খড়ি পোড়াতে হয়েছে।

    এলাকায় এখন আর কেউ সাপ মারে না। কারও বাড়িতে সাপ ধরা পড়লে হিমেলকে খবর দেয়। হিমেলের টিম  গিয়ে সাপটি উদ্ধার করে খামারে নিয়ে আসে। গ্রামে কারো বাড়ীতে সাপ আছে-এমন সংবাদ পেলেই ছুটে যান হিমেলও তার সঙ্গীরা। পরে সেই বাড়ীর বাসিন্দাদের সহযোগিতায় তা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন খামারে। মূলতঃ মানুষের হাত থেকে বিপন্ন সাপকে বাচাঁতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন তিনি। ফলে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন ‘সর্পপ্রেমী মানুষ’ হিসেবে।

    দেশী কোবরা, শঙ্খীনি জাতের দেশী জাতের সাপ নিয়ে গড়ে তুলেছেন খামারটি। প্রতিদিন সাপের খাবার সংগ্রহ, সময়মতো সাপের খাবার দেয়া, সপ্তাহান্তে সাপের বাক্স পরিস্কার করা, পরিস্কার পানি দিয়ে সাপের শরীর ধোয়ার কাজ করতে করতেই তার দিন পার হয়ে যায়। প্রথমে ২০/২৫টি সাপ নিয়ে কামারের কার্যক্রম শুরু করলেও এখন শতাধিকের উপরে সাপ আছে তার খামারে। প্রতিদিনই সাপ সংগ্রহ করতে প্রস্তুত রয়েছে তারা। কোন কোন দিন ৬/৭ সাপ ও সংগ্রহ করতে পেরেছে আবার কোন কোন দিন একটি সাপও ধরা সম্ভব হয়না।

    তার খামারে বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর গোখরা সাপ রয়েছে। একেকটি প্ল্যাস্টিকের খাঁচার মধ্যে একটি করে সাপ পালন করা হচ্ছে। খামারের বেশির ভাগ সাপই স্থানীয়ভাবে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার শতাধিক সাপের মধ্যে বিশেষ করে ৪/৫টি সাপ রয়েছে যার নাম ক্রেইট, ক্রেইট সাপ আবার অন্য সাপ খেয়েই বেচে রয়। সাপের প্রধান খাদ্য ব্যাঙ ধরে ধরে খাওয়ালে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে-এ আশংকায় কর্মকর্তারা কেউ রাজি হচ্ছিলেন না। তারা যুক্তিতে পরে তারা সায় দেয়। তিনি বুঝালেন তিনি নিজেই বিশেষ কৌশলে ব্যাঙের প্রজনন বৃদ্ধি করে নিকটস্থ জলাশয়ে ব্যাঙের সংখ্যা বাড়াবেন।

    সাপের বিষ বিদেশে রপ্তানির জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সরকার বেসরকারি উদ্যোগে সাপের বাণিজ্যিক খামার স্থাপনের জন্য ২০ টি শর্ত দিয়েছে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।

    হিমেল তাঁর সাপের খামারটি নিবন্ধনের জন্য গত বছর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। এখন পর্যন্ত খামারটি নিবন্ধন করা হয়নি। সম্প্রতি সাপ খামারী ও খামার নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে সাপ খামারীরা সাপের খামার স্থাপন করতে পারবে; কিন্তু বিষ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিক্রয় করতে পারবে না। এখন তার খামারে স্থায়ী-খন্ডকালীন কর্মী মিলিয়ে আছেন ৬/৭ জন। খামার ও বিষ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ মেশিনারীজ কিনতে প্রয়োজন অর্ধ কোটি টাকার মতো।

    সারাবিশ্বে ২০০৮ সালে পাঁচ হাজার ৭৭৫ কেজি সাপের বিষের চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছর সেটা পাঁচভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি বছরে আট হাজার ১২৬ কেজি চাহিদা রয়েছে। এই হারে চাহিদা বাড়তে থাকলে ২০২২ সালে তা দাঁড়াবে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকাতে।

    খামার থেকে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার বিষ উৎপাদন করা সম্ভব বলে তরুণ এই উদ্যোক্তা জানিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারি অনুমোদন না পাওয়া যায়। বিষ উৎপাদনসহ বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে পারছেন না তিনি। সাপ ধরতে ও পালন করতে লাঠি, টং, হাত মোজা, গ্ল্যাপস, পায়ে বড় বুট ব্যবহার করা হয়। বিষধর এই সাপ নিয়ে খেলা জীবনের সঙ্গে বড় বাজি। যখন তখন ঘটতে পারে মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনা। তাই জেলার হাসপাতালে দরকার সাপের কামড়ের এন্টি ভ্যাকসিন। বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় অনান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সাপের খামার করে বিষ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা অনেক সহজ। এতে খরচও অনেক কম। সরকারের সহযোগিতা ও খামারের নিবন্ধন পেলে তারা এ সাপের খামারের বিষ সংগ্রহ করে দেশের ওষুধের চাহিদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। পাশাপশি অর্জন করতে পাবে বৈদেশিক মুদ্রা।

    এদিকে, সাপ দেখতে প্রায় প্রতিদিনই খামারটিতে ভিড় করছেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ। কোন সাপ বিষাক্ত, সাপ ছোবল দিলে কি করা উচিত, কিভাবে বাঁধন দিতে হয় ইত্যাদি ব্যাপারে ধারণাও পাচ্ছেন এসব মানুষ।