দৈনিক ২৫ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ !
“মজিদ ও সিরাজুল নামের দুই জনকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করা হলেও কোন তদন্ত কমিটি নেই”
আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৯মার্চ,স্টাফ রিপোর্টার: মৌলভীবাজারের (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের) লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বনে প্রবেশের টিকেটের কোটি টাকা অভিনব কায়দায় প্রায় ৮ বছর যাবৎ সরকারী টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। ফলে সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব।
যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারাই যদি অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে সরকারী রাজস্ব খাতের টাকা নিজেরা নিয়ে নিচ্ছে, তাদের কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। এনিয়ে ফেসবুক ও জনমনে প্রশ্ন জেগে উঠেছে। রক্ষক যখন ভক্ষকের দায়িত্বে থাকে তখন স্থানীয়রা মনে করছে বন কর্মকতারা যদি সঠিক তরারকি করতো তাহলে এই চক্রগুলো এমনটা সাহস করতো না। কিন্তু চক্রটি এতোই পরাক্রমশালী যে এদের বিরুদ্ধে সরকারী কর্মকর্তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন না। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ও সরকার দলীয় সংসদ সদস্যের মদদপুষ্ট বলে এরা এলাকায় সর্বমহলে পরিচিত।
সম্প্রতি বন বিভাগের সহকারি বন সংরক্ষক এ অবৈধ আত্মসাৎ এর ঘটনা উদঘাটন করেন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারী এই ঘটনায় জড়িত দুই জনকে টিকেট বিক্রির দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
অপর দিকে এই অভিযোগে অব্যাহতি প্রাপ্ত মজিদ ও সিরাজুলকে কৌশলে ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ফিরিয়ে আনার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এতে সরকার দলীয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
চিরহরিৎ বনের মধ্যে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান একটি উল্লেখযোগ্য নমুনা।দেশের ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে সংরক্ষিত বনা ল লাউয়াছড়া অন্যতম।যার ফলে প্রতিদিন এই উদ্যানে আসেন শত-শত পর্যটক। আর পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত প্রবেশ টিকেটের অর্থ অভিনব কৌশলে দীর্ঘ দিন ধরে চুরি করে আসছে সঙ্গবদ্ধ একটি চক্র। যার ফলে সরকার হারিয়েছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনটি কৌশল অবলম্বন করে উদ্যানের রাজস্ব চুরি করা হয়েছে।এর প্রথম কৌশল হিসেবে এক টিকেট একাধিক বার বিক্রি করা হয়।টিকেট কাউন্টারের আব্দুল মজিদ দর্শনার্থীদের কাছে টিকেট বিক্রি করে। বিক্রিত টিকেট পর্যটকদের নিকট থেকে পুনরায় সংগ্রহ করে মজিদের কাছে নিয়ে আসত সহকারী সিরাজুল ইসলাম।এভাবে হাত ঘুরে ৫০ টাকার একটি টিকেট ৪ বার বিক্রি করা হতো।এতেও যখন তাদের লোভ সংবরণ হয়নি বরং বাড়তে থাকে, তখন দ্বিতীয় কৌশল হিসেবে তৈরি করে নকল টিকিট বই। পর্যটকদের ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নকল বই থেকে টিকিট দেয়া হতো।এছাড়া দর্শনার্থীদের প্রবেশ টিকেটের পর তৃতীয় কৌশল হিসেবে পার্কিংয়ের গাড়ির টিকেটের মূল্য চুরি করা হয়েছে।একটি বড় গাড়ি উদ্যানের প্রাঙ্গণে পাকিংয়ে সঠিক ভাড়া আদায় করলেও বন বিভাগকে সেই টিকেটের কম মূল্য দেখানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, লাউয়াছড়া উদ্যানের প্রতিদিন গড়ে ৫শ দর্শনার্থী আসে বেড়াতে। গত ফেব্রুয়ারীর ১৫ তারিখের আগ পর্যন্ত রাজস্ব আয় ছিল সর্বোচ্চ ৩৮ হাজার ৩৪১ টাকা ও সর্বনিম্ন ৭ হাজার ২২৮ টাকা। ফলে দৈনিক গড় আয় আগে ছিল ১৫ হাজার। কিন্তু এই অপরাধী চক্রটি সনাক্ত হওয়ার পর ১৫ তারিখের পর থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আয় হয়েছে ৮৭ হাজার ৬৭১ টাকা ও সর্বনিম্ন ১৭ হাজার ৯২৬ টাকা। বর্তমানের কিছুদিনের গড় রাজস্ব আয় দৈনিক ৪০হাজার টাকায় উঠেছে। অর্থাৎ দৈনিক প্রায় ২৫ হাজার টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে।এ হিসেবে গত ৮ বছরে কত টাকা আত্মসাৎ হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের নভেম্বর থেকে অভিযুক্ত আব্দুল মজিদ ও সিরাজুল ইসলাম টিকিট বিক্রির দায়িত্ব গ্রহণ করে।
এই চক্রের ২ জনকে অব্যাহতি দেয়ার পর থেকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা রেকর্ড পরিমাণেও দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কথিত প্রভাবশালী মদদপুষ্ট মজিদ ও সিরাজুল যোগদানের জন্য বিভিন্ন জায়গাতে তদবির করছে। খবর নিয়ে জানা যায়, মজিদকে উদ্যানের আশেপাশে ঘোরাফেরার করতে দেখা গেছে।
এ চক্রের হোতা আব্দুল মজিদ বিষয়টি অস্বীকার করেন। তাহলে কেন বন বিভাগ সাময়িক অব্যাহতি দিল? এমন প্রশ্নের জবাবে সিএমসির সভাপতি মো. মানিক মিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
বিশ্বস্থ সূত্রে জানা যায়, গত কয়েকদিন আগে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত বন বিভাগ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। তাদেরকে রাজস্ব আদায় থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। যেহেতু তারা কয়েক বছর যাবৎ এই চুরির সাথে সম্পৃক্ত সেহেতু সরকার লাখ লাখ টাকার রাজস্ব হারিয়েছে।
সুশিল সমাজ,নাগরিক ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি,লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত কো-ম্যানেজমেন্ট কমিটির কাছ থেকে সরিয়ে এনে সরকারী আওতায় আনা উচিৎ। তা না হলে রাজস্ব চুরির মত অপরাধ বৃদ্ধি পাবে এবং সরকার বিশাল অংশের রাজস্ব হারাতে বসবে।
বন বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সিএমসি একটি রাজনৈতিক পরিবারের কাছে বন্দি।এই পরিবারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।এই কমিটির বর্তমান ও সাবেক সভাপতি এই পরিবারের দুই ভাই।তা ছাড়া এই চক্রের ২ জনকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়ার পর থেকে সিএমসির বর্তমান সভাপতি সহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার মাধ্যমে ম্যানেজ’র চেষ্টা চলছে যাতে মজিদ ও সিরাজকে পুনরায় চাকরিতে ফিরিয়ে নেয়া হয়।
এ বিষয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সহব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) সভাপতি এম মোসাদ্দেক আহমেদ মানিক বলেন, বন বিভাগ যাদের অব্যাহতি দিয়েছেন তারা হচ্ছে সিএমসির স্টাফ।তাদেরকে শুধু সিএমসি বরখাস্ত করতে পারে।এছাড়া যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।আমাদের কমিটি বোর্ড মিটিং করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সহকারী বন সংরক্ষক কর্মকর্তা মো.তবিবুর রহমান জানান, মজিদ ও সিরাজুল যখন রেভিনিউ দায়িত্বে ছিল তখন তারা টিকেটের টাকা চুরি করতো। আত্মসাতের টাকার পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এত করে এই বনের রাজস্ব কমতো।তিনি আরোও বলেন ২০১৫ সালের অর্থ বছর আয় হয়েছে ২৬ লক্ষ টাকা, ২০১৬ সালে ৬২ লক্ষ এবং ২০১৭ সালে মোট আয় হয়েছে ৪১ লক্ষ টাকা।তবে ২০১৮ সালে টিকেটের মূল্য ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকাতে বৃদ্ধি করা হয়। বন বিভাগ চাইলেও সিএমসি স্টাফদের অবৈধ কার্যক্রমের ব্যাপারে কথা বলতে পারছেন না।
ডিএফও মিহির কুমার দো বলেন, অনিয়মের কারনে অব্যাহতিপ্রাপ্তরা বিভিন্ন মহলের মাধ্যমে পুনরায় ফিরে আসার জন্য সুপারিশ করাচ্ছে।লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহ.ব্যবস্থাপনা কমিটিতে আগামী সভায় এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে।