দেয়ালের অক্ষর থেকে নিয়ন সাইনের বিলবোর্ড

    0
    317

     

    অনলাইনে গেলেই এখন প্রচার। রাজনীতির, সমাজ সংস্কারের। ভোটের। ক্ষমতায় থাকার। ক্ষমতায় যাবার। প্রচার করছে মৌলবাদীরাও। জঙ্গিরাও পিছিয়ে নেই। তারাও সংগঠিত হচ্ছে, হতে চাইছে। বাংলাদেশের অনলাইন কিছু মিডিয়া এখন তাদের হিট বাড়াতে ব্যস্ত। তাই পর্নগ্রাফি থেকে আজগুবি যে কোনো খবরই হেডলাইন করতে কসুর করছে না কেউ কেউ।

    বিশ্বে গসিপ ম্যাগাজিনের অভাব নেই। কোনো মানুষ গোটা জীবনই গসিপ ভালোবেসে কাটিয়ে দেয়। কেউ এসব গসিপ থেকে বের হতে পারে। কেউ পারে না। আমার মনে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার প্রথম টার্মে একটি সেøাগান জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। উই উইল ম্যাক দ্য চেঞ্জ। সেই পরিবর্তন কতোটা কঠিন তা তিনি নিজেও জানেন। তারপরও স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখতে পারে বলেই মানুষ অন্যান্য জীবের চেয়ে পৃথক!

    বাংলাদেশের মিডিয়াজুড়ে এখন প্রধান খবর নির্বাচন। একটি রাষ্ট্রে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করলে আমরা দুটি বিষয় খুব গভীরভাবে লক্ষ করি। প্রথমটি হচ্ছে, জনগণের প্রত্যাশা। জনগণ মনে করেন তাদের ভোট প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আরেকটি পরিবর্তন সাধিত হবে। তারা শান্তির কাক্সিক্ষত আশ্রয় খুঁজে পাবেন। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, রাজনীতিকদের ক্ষমতায় যাবার উচ্চাকাক্সক্ষা। তারা অপেক্ষায় থাকেন, ক্ষমতা তাদের দখলে আসবে। এতোদিনের রাজনীতি করার ফসলটি ঘরে উঠবে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, জনগণের প্রত্যাশা এবং রাজনীতিকদের ক্ষমতায় যাওয়া এই দুটি স্বপ্নের সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায়।

    একটি জাতিসত্তার প্রতি একজন ব্যক্তি কিংবা কোনো গোষ্ঠী কতোটা অনুগত তা নির্ভর করে তার মৌলিক আচরণ প্রকাশের ওপর। আচরণটিও দুরকম হতে পারে। একটি লোক দেখানো, অন্যটি আত্মিক। যারা মনেপ্রাণে কোনো জাতিসত্তাকে স্বীকার করে এবং ভালোবাসে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে না। প্রশ্ন ওঠে তাদের দেশপ্রেমের প্রতি, যারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু ভেতরে ভেতরে সুযোগ খুঁজে জাতিসত্তাকে ধ্বংস করে দেয়ার। মূলত এদের শ্রেণী চরিত্র কি হচ্ছে আত্মপ্রতারক। তারা একটি দেশে অবস্থান করেও ব্যস্ত থাকে সে দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে। তারা রাষ্ট্র এবং জনগণের পিঠে ছুরি মেরে নিজেদের কায়েমি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

    এটা বাংলাদেশের মানুষের চরম দুর্ভাগ্য, জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ‘জনগণের ক্ষমতাই সকল উৎস’ এই তত্ত্বে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বুলি আওড়ালেও তারা তার চর্চা থেকে বিরত থেকেছেন বারবার। বরং তারা জনগণের ক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করেছেন বিভিন্নভাবে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ‘প্রাথমিক পর্যায়ে প্রার্থী নির্বাচন’ পদ্ধতি না থাকায় দলই প্রার্থী চাপিয়ে দিয়েছে জনগণের ওপর। দেখা গেছে মন্ত্রী, শীর্ষ নেতানেত্রীদের প্রিয়ভাজন যারা হতে পেরেছে তারাই নমিনেশন পেয়েছে। একটি দেশের পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বন্দী করে রেখে দেয়া হয়েছে শীর্ষদের হাতের মুঠোয়। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্যায়নই করা হয়নি অধিক ক্ষেত্রে।

    গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য ভোটের কোনো বিকল্প নেই। একটি বৈধ সংসদই দিতে পারে রাষ্ট্রকে চলার পথদিশা। কিন্তু যোগ্য লোককে নির্বাচিত করার নামে সংসদ যদি রাবার স্ট্রাম্পে পরিণত হয় তবে সব আশা-আকাক্সক্ষাই বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

    কোনো দেশে লোভী বুর্জোয়া শ্রেণী যখন তীব্র ভোগবাদী হয়ে সব কিছু গ্রাস করতে তৎপর হয় তখন কাউকে না কাউকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। ওয়ান-ইলেভেন তেমনি একটি পরিস্থিতিতেই সৃষ্টি হতে বাধ্য করা হয়েছিল বাংলাদেশে।

    এসব কথা বাংলাদেশের মানুষের, রাজনীতিকদের ভুলে যাবার কথা নয়। তারপরও রাজনীতিকরা সেই শিক্ষা নেননি। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, পছন্দ-অপছন্দের দোলচালে ড. ইউনূস ইস্যু নিয়ে টানাহেঁচড়া করেই যাচ্ছে এই সরকার।

    এর কি কোনো দরকার ছিল? অন্যান্য সরকারি ব্যাংকগুলো যখন হলমার্ক কেলেঙ্কারির পতাকা উড়াচ্ছে, তখন গ্রামীণ ব্যাংক এককভাবে সরকারের চক্ষুশূল কেন হবে? এই সুযোগে ইউনূস তার সমর্থন পাকাপোক্তই করছেন বিএনপির প্রতি। সম্প্রতি তিনি বলেছেন- ‘আমরা দেশে স্থায়ীভাবে শান্তি চাই। আর সেই শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। তাই আগামী নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ হয় সে জন্য একটি প্রক্রিয়া আমাদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যাতে নির্বাচন-পরবর্তী অশান্তি না হয়।’

    তিনি আরো বলেছেন- ‘শান্তি প্রক্রিয়াটি যদি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তাহলে যারা শান্তি দিতে পারবে তাদের আমরা ভোট দিতে পারবো। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার পর এতো বছর পেরিয়ে গেলো অথচ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার যোগ্যতা আমরা অর্জন করতে পারিনি। যারা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, ভয়ভীতি দেখাবে না, ধমক দিবে না, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে।’

    বাংলাদেশে ভিশন ২০২১-এর কথা বলেছিল আওয়ামী লীগের মহাজোট। এখন নতুন ধারার রাজনীতি ২০২৫-এর হাওয়া উড়াচ্ছে বিএনপি। এসব ফানুস আসলে ‘সংস্কারের’ একটি দলীয় ম্যানিফেস্টো।

    সংস্কার সম্পর্কে কিছু চমৎকার কথা বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের এ সময়ে বহুল আলোচিত চিত্রপরিচালক মাইকেল মুর। তিনি ফারেনহাইট নাইন-ইলেভেন ছবিটি পরিচালনা করে সাড়া জাগিয়েছেন গোটা বিশ্বে। নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে তার সঙ্গে জমপেশ আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা ক’জন। মাইকেল মুর বুশের যুদ্ধনীতির কড়া সমালোচক। তিনি বলেছিলেন, আপনি নিশ্চয়ই বহুদিন একটি শার্ট পরতে চাইবেন না। পুরোনো শার্টটি ফেলে দিয়ে কিছু দিন পর নিশ্চয়ই একটি নতুন শার্ট কেনেন। আর এটাই হচ্ছে নিজের সংস্কার। মাইকেল মুর আরো বলেছিলেন, বুশ প্রকৃতপক্ষে বিশ্বে একটি সংস্কার চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, বুশের সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মানবদেহের রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল। তাহলে নিশ্চয়ই আমরা এমন সংস্কার চাই না, যা কিনা আমাদের বসবাসযোগ্য বিশ্বকে বিষিয়ে তোলে।

    কোনো কোনো ব্যক্তির একটি কথাই অনেক কিছু আমাদের বুঝিয়ে দেয়। এর জন্য বেশি বলার দরকার হয় না। বললে তো শব্দ হয়। অনেকে তা শোনে। কোনো শব্দ না করেও কিছু বলা যায়? হ্যাঁ যায়। আমরা তাকে চোখের ভাষা বলি। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের কবি জন ব্যারিম্যানের কথা। প্রখর মানবতাবাদী, মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের এই কবি তার প্রেমিকাকে বলেছিলেন তুমি যদি পাঁচ মিনিট আমার দুটি চোখে চোখ রেখে অপলক তাকিয়ে থাকো তবে আমি পাঁচশ লাইনের একটি কবিতা লিখে ফেলতে পারবো নিশ্চিন্তে। এই পাঁচ মিনিট কী দেখবেন কবি? কী খোরাক পাবেন তিনি পাঁচশ লাইন লেখার? তা কবিই বলতে পারবেন। আর হয়তো তারাও পারবেন, যারা চোখের ভাষা বোঝেন।

    বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা জনগণের চোখের ভাষা বুঝেননি। বুঝার চেষ্টাও করছেন না। তা না হলে, তারা এমনভাবে হারবেন কেন? বিলবোর্ড লাগিয়ে যারা আত্মপ্রচার চেয়েছিলেন, তারা কি দেয়ালের লেখা পড়েছিলেন? যদি পড়তেন তাহলে তারা এতো বেশি কালো বিড়াল পুষতেন না।

    শেষ অধিবেশন বসছে এই মহান জাতীয় সংসদ মেয়াদের। এই সংসদেই একটা সুরাহা হোক আগামী নির্বাচনের। একটা আশার আলো দেখুক এ দেশের মানুষ। আমরা আর রক্তপাত চাই না। মানুষের ভোট না পেলে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না যাবে না। এটাই যদি সত্য হয়, তবে সাড়ে চার বছরে যা পারা যায়নি, দুমাসে তা শেষ করতে পারবে না মহাজোট সরকার।

    এই লেখাটি যখন লিখছি তখন জেনে গেছি সিরিয়া আক্রমণের জন্য প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র! এই খবর গোটা বিশ্ববাসীর জন্য উদ্বেগের। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে একটি শান্তিময় বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের শক্তিতে উজ্জ্বল একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন, প্রজন্ম সেই প্রত্যাশা করেই যাচ্ছে।ফকির ইলিয়াস : কবি ও সাংবাদিক।