দুই প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে ঐতিহাসিক সম্পর্কের আশাবাদ

    0
    487

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২৬মে,ডেস্ক নিউজঃ ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিয়ে আগামীতেও বন্ধু হয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে সমাবর্তন অনুষ্ঠান ও বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনে এসে এ আশাবাদের কথা ধ্বনিত হয়েছে।

    অনুষ্ঠানে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন শেষে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, বৈঠকের আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ও আন্তর্জাতিক বিষয় স্থান পায়। এছাড়া বিকালে প্রধানমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী পরিদর্শনে যান। সেখানে বাংলাদেশ গ্যালারি হবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন। সন্ধ্যায় হোটেল তাজ বেঙ্গলে কলকাতার ব্যবসায়ী নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আজ দ্বিতীয় দিন শনিবার সকালে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে যোগ দিতে আসানসোল যাবেন শেখ হাসিনা। সমাবর্তনে শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি দেওয়া হবে। কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও বক্তৃতা দেবেন। এছাড়া সেখানে শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

    শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে কলকাতার স্থানীয় সময় ৯টা ২৫ মিনিটে নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে বীরভূমে শান্তিনিকেতনে পৌঁছালে বিশ্ব ভারতীর ভিসি অধ্যাপক সবুজ কলি সেন তাকে অভ্যর্থনা জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র ভবনে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি বিশ্বভারতীর আচার্য। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯তম এ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা যোগ দিচ্ছেন ‘গেস্ট অব অনার’ হিসেবে। সমাবর্তনস্থলে যাওয়ার আগে তিনি রবীন্দ্র চেয়ারে শ্রদ্ধাও জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন শুধু পশ্চিমবাংলার নয়। দুই দেশের। রবীন্দ্রনাথ শুধু ভারতের নয়, বাংলাদেশেরও। নজরুলও দুই দেশের। তিনি বলেন, আমি এখানে আসতে পেরে খুবই আনন্দিত। রবীন্দ্রনাথ আজ আমাদের দুই দেশের মানুষের মননে জড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনের সবকিছুর সঙ্গে মিশে আছে। আমি মনে করি বিশ্বভারতী আমারও বিশ্ববিদ্যালয়।

    প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতবাসী আমাদের পাশে ছিল। ভারতবাসীর সেই অবদান আমরা ভুলব না। তিনি বলেন, একটা প্রতিবেশী দেশ থাকলে সমস্যাও থাকতে পারে, আমরা কিন্তু সমস্যাগুলো একে একে সমাধান করে ফেলেছি। হয়তো কিছুটা বাকি, আমি সে কথা বলে আমাদের এ চমৎকার অনুষ্ঠান নষ্ট করতে চাই না। কিন্তু আমি আশা করি, যে কোনো সমস্যা আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের মাধ্যমেই সমাধান করতে পারব। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, যে কোনো সমস্যা আমরা বন্ধুত্বপূর্র্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে সমাধান করতে পারব। স্থলসীমানা চুক্তি ভারতের সংসদে পাস হয়ে গিয়েছে। ছিটমহল চুক্তি শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। বন্ধু হয়ে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের কাছে এটা একটা উদাহরণ। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত যথেষ্ট সহযোগিতা করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের কৌশলগত বন্ধুত্বকে অপরাপর বিশ্বের জন্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দিতে পারি যে, উভয় দেশ সহযোগিতার এ মনোভাব ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে।

    শেখ হাসিনা বলেন, আমি চাই, বাংলাদেশকে দরিদ্রমুক্ত করতে। মানুষের মুক্তির জন্য আমাদের সংগ্রাম। বাংলাদেশকে মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে তুলে ধরতে চাই। এদিন আবেগতাড়িত হয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কষ্টের সময় আশ্রয় দিয়েছে ভারত। শেখ মুজিবুর হত্যার সময় পাশে ছিলেন ইন্দিরা। সে সময় আশ্রয় না পেলে কী হতো জানি না। হাসিনা আরও বলেন, বাংলাদেশ নির্যাতিতাদের আশ্রয় না দিয়ে পারে না। ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি আমরা। আমরা তাদের তাড়াতে পারি না। ১৬ কোটি মানুষকে যখন খাওয়াতে পারছি, বাকিদের পারব না কেন? দরকার হলে খাবার ভাগ করে খাব। এদিন সর্বশেষে শেখ হাসিনা ভারত বাংলাদেশের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। এরপরই বিশ্বভারতীর আম্রকুঞ্জের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি বাংলায় সবাইকে শুভসকাল ও প্রণাম জানান। এরপর তিনি হিন্দিতে বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, এই শুভদিনে সবাইকে প্রণাম। কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে এসে আমি গর্বিত। বিশ্বভারতীতে আমি অতিথি নই, আমি আচার্য হিসেবে এসেছি। গুরুদেবের বিশ্বভারতী আমার কাছে মন্দিরের মতো। এক ছাতায় গোটা বিশ্বকে এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সারা বিশ্বকে আপন করে নিয়েছিলেন গুরুদেব। রবীন্দ্রনাথই প্রথম বিশ্ব নাগরিক। এদিন মোদি আরও বলেন, এক সমাবর্তনে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। এমন সমাবর্তন আর কোথায় হয়েছে? যে স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গুরুদেব, তাকে এগিয়ে নিয়ে চলার কাজ আজও চলছে। মোদি ভারত ও বাংলাদেশের প্রসঙ্গে বলেন, ভারত এবং বাংলাদেশ দুটি পৃথক রাষ্ট্র, কিন্তু আমাদের স্বার্থ পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। সেটা হোক সংস্কৃতি বা জননীতি। আমরা একে অপরের থেকে প্রচুর শিখি। তারই একটা উদাহরণ বাংলাদেশ ভবন। এদিন বিশ্বভারতীতে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনের পর বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন মোদি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতবাসী যেভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল সেই কথা স্মরণ করে মোদি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ সেই সময় যে যন্ত্রণা পেয়েছেন, তা অনুভব করেছেন এপারের বাসিন্দারাও। মোদি জানান, প্রতি মুহূর্তে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে ভারত। প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সাহায্য করছে ভারত সরকার। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতিতে ভারত বাংলাদেশকে সব রকমের সাহায্য করছে বলেও উল্লেখ করেন মোদি।

    আজ হাসিনা-মমতা বৈঠক : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। শনিবার দুইজনের মধ্যে এ বৈঠক হবে বলে জানিয়েছেন খোদ পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী সমাবর্তন এবং বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার শান্তিনিকেতনে এসে মমতা বলেন, হাসিনাজির সঙ্গে আমার একটি বৈঠক ঠিক করেছি। সেটা শনিবার উনি বাংলাদেশ ফিরে যাওয়ার আগে হবে। ওইদিন সন্ধ্যাবেলা আমরা দুইজন কথা বলব। আমি হাসিনাজিকে খুব ভালোবাসি, উনিও আমাকে খুব স্নেহ করেন। হাসিনাজি আসছেন, সঙ্গে ওর ছোট বোন রেহানা আসছেন। আরও অনেক বাংলাদেশের মন্ত্রীরা আসছেন। আমরা খুব খুশি যে, তারা আসছেন। আমাদের এই সম্পর্ক, আমাদের এই আন্তরিকতা চিরকালীন। দুই দেশের মধ্যে আমরা অনেক সময় বৈঠক করেছি। উনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে খুব ভালোবাসেন। এপার বাংলা ওপার বাংলার মধ্যে সম্পর্ক চিরকালীন, সর্বজনীন এবং বিশ্বজনীন। এটা বিশ্ববাংলার একটা রূপরেখা, এখানে কোনো সীমারেখা কাজ করে না। এখানে আমাদের সভ্যতা, আমাদের আন্তরিকতা, আমাদের সংস্কৃতি কাজ করে। উনিও আমায় খুব ভালোবাসেন।

    গত কয়েক বছর আগে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সময় উনি ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। খুব সম্মান দিয়েছিলেন। শুধু আজ নয়, উনি যখন বাংলাদেশে বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন, তখনও আমার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আজ নয়, চিরকাল। আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চিরকাল থাকবে। বাংলাদেশকে আমার অভিনন্দন। বাংলাদেশ আরও ভালো থাকুক, আরও এগিয়ে চলুক। ভারতবর্ষের এবং বাংলাদেশের আরও উন্নতি হোক, এটা আমরা সব সময়ই চাই। মমতা বলেন, শনিবার হাসিনাজির সঙ্গে আমার একান্ত সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার হবে। মমতা এদিন বাংলাদেশ থেকে ইলিশ মাছ আমদানি প্রসঙ্গে বলেন, ইলিশ তো আমরাও তৈরি করছি। বাংলাদেশ তো দেয়, আমি কেন ইলিশ নিয়ে ঝগড়া করতে যাব? বাংলাদেশের ইলিশ তো আমরা খাই। সুতরাং দুই দেশের ইলিশ খাব। দুই বাংলার মিলন ছিল, আছে, থাকবে। পশ্চিমবাংলার সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমরা সবাই এক।

    পশ্চিমবাংলায় বঙ্গবন্ধুর নামে ভবন হবে : রবীন্দ্র-নজরুলকে বাদ দিয়ে পশ্চিমবাংলা যেমন ভাবতে পারে না, ভারতবর্ষও ভাবতে পারে না, তেমনি বাংলাদেশও রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বাদ দিয়ে কিছু ভাবতে পারে না। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল, আছে এবং থাকবে। মমতা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। পদ্মা মেঘনা গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্ক আজ নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়েছে। বন্ধুত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়েছে। মমতা বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম দুই বাংলার। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল একই বৃত্তে দুটি কুসুম। তিনি বলেন, আমরা আমাদের পশ্চিমবাংলায় নজরুল একাডেমি করেছি, নজরুল তীর্থ তৈরি করেছি। আগামী দিনে বঙ্গবন্ধুর নামেও একটি ভবন করতে চাই। এদিন সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা শেষে মমতা ব্যানার্জি রমজান ও ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকদের শুভেচ্ছা জানান।