জৈন্তাপুর করগ্রামের বড়জুরী-ছোটজুরী আরেক রাতারগুল

    0
    248
    রেজওয়ান করিম সাব্বির, জৈন্তাপুর (সিলেট) প্রতিনিধিঃ সিলেটের জৈন্তাপুরে করগ্রামের বড়জুরী ও ছোটজুরী জলারবন পর্যটকদের জন্য হতে পারে অন্যতম নির্দশন। সন্ধ্যা আসার তখনো অনেকটা সময় বাকি। কিন্তু হিজল, করই, ইকড় বিন্না ও পাখির কিছির মিছির ডাকে প্রকৃতির অপরুপ বাজনা বেজে উঠে করগ্রামের হাওরের বড় জুরী ও ছোট জুরী হাওর। মনে হয় যেন এখানে প্রকৃতির সর্বজনীন নিয়মের ব্যতয় ঘটিয়েছে। ডাহুক, শামুকউজা, কানাবক, ঘুঘু, মাছরাঙা, বালিহাস সহ নাম না জানা বিচিত্র সব পাখীদের কলরবে মুখরিত চারদিক। সন্দ্যায় শিয়ালের হুক্কা হুয়া আওয়াজ সেটিকে করে তুলেছে আরও বেশি জীবন্ত। দর্শনীয় হাওরটি পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠতে পারে আর্কষনীয়৷
    সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শতবর্ষী অগণিত হিজল, করই গাছ মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া পুটিজুরী নদী। বর্ষায় কোমর পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে গাছগুলো। মাথায় পাতার বিশাল ঝাঁপি নিয়ে সাধকের মতো যেন পাহারা দিচ্ছে পুরো জলারবনকে। ঘন ইকড় আর খাগ ও ছন থেকে থেকে ভেসে আসে শিয়ালের ছুটোছুটির শব্দ। শুকনো মৌসুমে দিনের বেলা মৎস্যজীবিদের মাছ ধরা এবং বোরো ধান চাষীদের চাষাবাধের তৎপরতা নেই কোন কমতি। সন্ধ্যা হতে না হতে শিয়াল সহ বন্য প্রানীদের বিচরন যেন মাতিয়ে রেখেছে। শিয়াল, নেউল কিংবা উদ বা বনবিড়ালরা বেরিয়ে পড়ছে রাতে খাবারের নেশায় । বনের ফাঁকের ছোট ছোট কুপে গজার, বোয়াল আর শোলমাছ শিকারীদের পাতানো ফাঁদ। সন্ধ্যার আগেই এখানে নেমে রাত্রির পুরো আয়োজন। প্রকৃতির এরকম বিচিত্র সব কারবার আর মনমাতানো সৌন্দর্য্যে দেখা মিলে কারগ্রাম ও চাল্লাইন হাওরের মায়াবী জলারবনটিতে।
    সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এবং তৈল গ্যাসের জন্য সারা দেশের গন্ডি প্রেরিয়ে বিশ্ব জুড়ে বিখ্যাত। শ্রীপুর, সাইট্রাস গবেষনা কেন্দ্র, লাল শাপলার রাজ্য, হরিপুরের গ্যাসকুপ, সারী নদীর নীল জল, লালাখাল চা-বাগান, নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে কথা কে না জানে! ২০১৭ সালে একটি বে সরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনে প্রতিবেদন প্রচারের পর হতে স্থানীয় পর্যটকদের নিকট ভ্রমণের স্থানের তালিকায় নতুন করে জায়গা দখল করে করগ্রামের ’বড়জুরী ও ছোটজুরীর জলারবন’। চলতি বৎসর জুড়ে ভ্রমন পিপাসুরা ভিড় জমাচ্ছে বড়জুরী ও ছোটজুরী হাওরে। প্রকৃতির এ অসাধারণ বনে চারদিকে কেবলই মনমাতানো সৌন্দর্য্য। প্রকৃতি তাঁর অকৃপণ হাতে সাজিয়েছে বনটিকে। বর্ষায় চারদিকে অথৈ পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে হিজল, করচ, বরুণ, শেওড়া সহ দেশী পানিবান্ধব নানা প্রজাতির গাছ গাছালি। সে গাছ গুলোর ঝোপ জঙ্গলের নিবিড়তা অন্য যে কোন বনভূমির চেয়ে বেশি। গাছের মধ্যে আবার হিজলের সংখ্যা লক্ষ্যণীয় ভাবে বেশি। মানুষের ছোঁয়া বহির্ভূত সেসব গাছ তাঁর আদি রুপ অনেকটাই ধরে রেখেছে। এসবের মধ্যে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইকড় আর ছনের বন। যেন সাপ, বিচ্চু আর পাখীদের এক নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র।
    বিলের পানির মধ্যে রয়েছে দেশীয় প্রজাতির নানা প্রকার মাছ। তাছাড়া উদবিড়াল, কচ্ছপ, গুইসাপসহ রয়েছে উভচর প্রাণী। বর্ষায় বাতাসের ঢেউয়ে যখন পানি আচঁড়ে বনের উপর, তখন এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। শুস্ক মৌসুমে তার ব্যতিক্রম নয়। এছাড়া বনের মধ্যে নৌকায় করে এবং শুস্ক মৌসুমে সাইকেল যোগে গেলে মনে হবে- কোন দিক রেখে যে কোন দিকে তাকাবো! সামনে তাকালে মনে হয় পেছন দেখা দরকার, পেছনে তাকালে মনে হবে ডানপাশের বন মিস করছি! শুস্ক মৌসুমে অভিন্ন রুপ ধারন করে জলার বনটি। মৎস্যজীবিরা মাছ শিকারের পর বিল শুকিয়ে গেলেই তৈরী হয় অন্যন্য দৃশ্য যে দিকে থাকাবেন মনে হবে প্রকৃতি নিজ হাতে সাজিয়ে তৈরী করেছে বিশাল খেলার মাঠ। সবুজ ঘাসে ঢেকে যায় পুরো এলাকা দেখলে মনে হবে সবুজের একখন্ড বিছানা। সত্যিই এক অপূর্ব অসাধারনত্ব নিয়ে জলার বনটি নিজের আপনত্ব ধরে রেখেছে।
    সরেজমিনে হাওরে গিয়ে দেখা যায় স্থানীয় এলাকা সহ বিভিন্ন স্থান হতে আসা পর্যটকরা ঘোড়া, বাধ্যযন্ত্র নিয়ে মনের অনন্দে বনটির ভিতরে নেচে গেয়ে সময় কাটাচ্ছে কেউবা খেলা করছে। তাদের একজন কামাল আহমদ বলেন আমাদের বাড়ীর পাশ্বে মায়াবর্তী দৃশ্য নিয়ে হাওরের বনটি অবস্থিত। যখন সময় পাই তখন কিছু সময় বনটিতে ঘুরতে আসি এখানকার প্রকৃতি অত্যান্ত মনোমুগ্ধ কর। এছাড়া নাছির রাশেল, আব্দুল কুদ্দুছ, সফিকুল, মো. সুলেমান, শাহজালাল ভূইয়া ইমন সহ অনেকেই তাদের কথা বক্ত করতে গিয়ে বলেন, এই হাওরের এমন দৃশ্য রাতার গুলে নেই। শতবর্ষী গাছ এবং পাখির কিছির মিছির শব্দ খুব ভাল লাগেছে। বর্ষা এলে ফের এখানে ঘুরতে আসব। ঘুরতে আসা প্রবাসী সুলেমান বলেন, প্রবাসে থাকাবস্থায় বেসরকারী টিভি চ্যানেল-২৪ প্রতিবেদনটি দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমাদের করগ্রাম হাওরে এত সুন্দর জায়গা রয়েছে। তাই বাড়ীতে এসে বন্ধুদের নিয়ে একনজর দেখতে এসেছি। জায়গাটি এত মনোমুগ্ধকর যে আমার কাছে মনে হল টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদক যে টুকু সম্প্রচার করেছেন তার চাইতে অনেক অনেক বেশি সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে রয়েছে। তবে বর্ষায় এলে হয়ত আরও ভাল লাগত।
    গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বড়জুরী এবং ছোটজুরী নামক হাওর দুটি সরকারি মালিকানায় রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে পুটিজুরী নদী তার অনতিদূরে রয়েছে কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ী অন্যপাশ্বে জৈন্তাপুর উপজেলার করগ্রাম চাল্লাইন সহ কয়েকটি গ্রাম। তবে মূলত: করগ্রামের লোকজন এটি ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি। মিডিয়াতে না আসায় জলারবনটি এখনও পর্যটক ও বাইরের মানুষের কাছে অপরিচিত। বিশেষ করে এই এলাকার বাসিন্দারাও চায় না জলার বনটি পর্যটকদের দৃষ্টিতে পড়ুক। কারন অনুসন্ধানে জানাযায় বনটি পরিচিতি পেলে সরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও স্থানীয় মানুষদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটিকে আরও সমৃদ্ধ সোয়াম্প ফরেস্ট করে ফেলবে। তাছাড়া সিলেট তামাবিল মহাসড়কের পূর্ব পাশ্বে হওয়ায় জাফলং শ্রীপুর লাল শাপলার রাজ্য এবং লালাখালে ঘুরতে আসা পর্যটকরা বিড় জমাবে জলারবনটিতে। ফলে প্রকৃতির সুবিধা ভোগিরা নানা বিড়ম্বনায় পড়বে। তারা চায় কোন ভাবেই যেন এটি মানুষের কাছে আকর্ষণীয় পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্্ের পরিণত না হয়। তাদের নিজস্ব ইকোসিস্টেম ধবংসের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।
    যাতায়াত: বর্ষায় সিলেট-তামাবিল সড়কের হেমু করিসের ব্রীজ কিংবা দামড়ী ব্রীজ হতে নৌকা যোগে ঘন্টা খানেক সময় পূর্ব দিকে এবং শুকনো মৌসুমে দরবস্ত বাজার হতে কানাইঘাট রাস্তা দিয়ে করগ্রাম রাস্তা ধরে ২০ থেকে ২৫ মিনিটেই পৌছা যায় হাওর দুটিতে। প্রায় ২ হাজার একর আয়তনের এ জলারবন তাঁর রুপের মাধুরী আর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিজের অস্তিত্ব ধরে আছে।
    সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট প্রধান সমন্বকারী আবদুল হাই আল-হাদী প্রতিবেদককে জানান, বড়জুরী ও ছোটজুরী নামক বিল দুটিকে পর্যটনের আওতাভূক্ত করা হয় তাহলে পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়বে। তার পাশাপাশি অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্র গুলো কাছাকাছি অবস্থান হওয়ায় এর গুরুত্ব পর্যটকদের সুবিধা হবে। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি আর্কষনের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
    জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন প্রতিবেদককে জানান, আমাদের উপজেলায় বিভিন্ন প্রান্তে এরকম পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে এই হাওরটি অন্যতম। সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন সহ উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন। তিনি আরও বলেন পরিকল্পনা মাফিক এটি সাজিয়ে তুললে অন্যান্য জলার বনের চেয়ে এটি হয়ে উঠবে আরও আর্কষনীয়।