জেল হত্যাঃ৩ নভেম্বর এই সরু ড্রেন ভেসে যায় রক্তে !

    0
    265

    গুলিবিদ্ধ নেতাদের কেউ কেউ একচুমুক পানি চেয়েও পাননি। উপরন্তু ঘাতকরা পুনরায় কারাকক্ষে ঢুকে বেয়োনেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে

    জাতীয় চার নেতাকে কারাগারের যে কক্ষে হত্যা করা হয়, তার ঠিক সামনে একটি সরু ড্রেন। এখনও আছে। ’৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এই ড্রেন ভেসে যায় রক্তে। ভোরের আলোয় তাজা রক্ত দেখেই পাশের কক্ষে থাকা অন্য বন্দীরা জানতে পারেন, প্রিয় নেতারা আর নেই ! গুলিবিদ্ধ নেতাদের কেউ কেউ একচুমুক পানি চেয়েও পাননি। উপরন্তু ঘাতকরা পুনরায় কারাকক্ষে ঢুকে বেয়োনেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে।

    মর্মন্তুদ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাইদুর রহমান প্যাটেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এমন তথ্য। চরম দুর্যোগের কালে জাতীয় চার নেতার সঙ্গে একই জেলে বন্দী ছিলেন তিনি। সে সময়ের টগবগে যুবক আওয়ামী লীগ নেতা এখন সত্তরোর্ধ। তবে হত্যাকান্ডের ঘটনা তার হুবহু মনে আছে। স্মৃতি থেকেই শুধু বলেন না, অন্ধকার সময়ের অলিগলিতে আলো ফেলতে ফেলতে যান। মাঝে মধ্যেই আবেগে কণ্ঠ বুজে আসে তাঁর। চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে অতীতটা পরিষ্কার দেখতে পান। দেখান। ঘটনা ও ঘটনার আলোকে পূর্বাপর ব্যাখ্যা করেন তিনি।

    তাঁর ব্যাখ্যা শোনার আগে ঘুরে আসা চাই কেন্দ্রীয় কারাগারের পুরনো ভবন থেকে। মূল ফটক ধরে কিছুক্ষণ হাঁটলে হাতের বাঁ পাশে একটি সরু রাস্তা। রাস্তাটি ধরে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে গেলে অভিশপ্ত কক্ষ। এ কক্ষটিতেই হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। বর্তমানে এটিসহ পাশের দুই কক্ষ নিয়ে জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে।

    জানা যায়, তার আগে ব্রিটিশ আমলে ভবনটি ছিল মিনি সিনেমা হল। নাম ছিল শকুন্তলা। পরবর্তীতে নিউ জেল নামে পরিচিতি পায়। তিনটি বড় কক্ষ নিয়ে নিউ জেল। সাদা চোখে দেখলে মনে হতে পারে নতুন ভবন। আদতে, রং করা। যতটা সম্ভব সুন্দর করার করার চেষ্টা হয়েছে। এর পরও বেদনার রং ঢাকা যায় না। একতলা ভবনের সামনে দাঁড়াতেই মন ভারাক্রান্ত ওঠে।

    বর্বর হত্যাকান্ডটি ঘটেছিল ১ নম্বর কক্ষে। এখানে চার নেতাকে জড়ো করে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে ঘাতকরা। কক্ষটির বর্তমান নাম ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’। সামনে একটি নামফলক। ফলকের ইটগুলো রক্তের মতো লাল। মূল অংশে শেতপাথরে লেখা চার মৃত্যুঞ্জয়ীর নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয়। ফলক থেকে চোখ তুলে সামনে তাকালে লোহার গ্রিল। বাইরে দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়েছিল খুনীরা। কতটা বিদীর্ণ হয়েছিল বুক-সে প্রমাণ এখনও ধারণ করে আছে লোহার শিক। একাধিক শিকে খোঁড়লের সৃষ্টি হয়েছে। লাল রং দিয়ে খোঁড়লগুলো চিহ্নিত করা। দেখে গা শিউরে ওঠে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কক্ষের অভ্যন্তরে চোখ রাখলে দেখা যায় ছোট চৌকি। এত ছোট যে, শোয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না। অথচ এমন চৌকিতেই ঘুমোতে হয়েছে নেতাদের। গ্লাস শোকেসে রাখা চৌকির পাশে একটি হাতাওয়ালা কাঠের চেয়ার। ছোট্ট টেবিল। এ কক্ষেই থাকতেন দেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তাদের কোন একজনের ব্যবহৃত চৌকি চেয়ার টেবিল প্রদর্শিত হচ্ছে কক্ষের ভেতরে।

    দ্বিতীয় কক্ষটি দেখতে প্রায় অভিন্ন। একই রকম চৌকি ও টেবিল চেয়ার পাতা। এখানে রাখা হয়েছিল এএইচএম কামারুজ্জামানকে। তার ব্যবহৃত চৌকি এবং টেবিল চেয়ারটিও কলঙ্কজনক ইতিহাসের স্মারক হয়ে আছে। এম মনসুর আলীকে রাখা হয়েছিল ৩ নম্বর কক্ষে। তবে দর্শনার্থীর জানার আগ্রহ থাকলেও জাদুঘরের কোথাও জেল হত্যার ইতিহাসটি উল্লেখ করা হয়নি।

    এবার ফিরে যাওয়া যাক সাইদুর রহমান প্যাটেলের কাছে। প্রকৃত ইতিহাসটি জানতেই তার কাছে যাওয়া। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহধন্য সাবেক ফুটবলার প্যাটেল। শেখ কামালেরও ঘনিষ্ট বন্ধু। দুঃসহ স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ট হওয়ায় আমাকে গ্রেফতার করা হয়। রাখা হয় নিউ জেলের ৩ নম্বর কক্ষে। কক্ষটিতে ঢোকার পরই জানতে পারি এখানে আছেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। চোখের সামনে দেখতে পাই তাঁকে। আমার বেডের ঠিক উল্টো দিকে মনসুর আলী সাহেবের বেড। বেড বলতে কাঠের চৌকি। এ কক্ষে মোট সতেরোটি কাঠের চৌকি ছিল জানিয়ে বাউল বলেন, কয়েকটি এখন নিদর্শন হিসেবে জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

    বাকি চৌকিগুলোয় কারা থাকতেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেব ছিলেন, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বোনের হাজব্যান্ড সৈয়দ হোসেন। ছিলেন মতিঝিলের এমপি শামীম মিসির, শামীম ওসমানের বাবা জোহা, রংপুরের এমপি আজহার, শ্রমিক নেতা কাজী মোজাম্মেল ও আমির হোসেন আমু ভাই। সব মিলিয়ে ১৭ জন।

    অন্যান্য কক্ষ সম্পর্কে জানতে তিনি বলেন, সেগুলোতেও যাওয়া আসা ছিল আমার। ২ নম্বর কক্ষে ছিলেন কামরুজ্জামান সাহেব। একই কক্ষে অন্যদের মধ্যে ছিলেন হাশিম উদ্দিন হায়দার পাহাড়ী। বঙ্গবন্ধুর সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা মহিউদ্দিন ভাই ছিলেন। ছিলেন সচিব আসাদুজ্জামান। একেবারে জুনিয়রদের মধ্যে ছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। ১ নম্বর কক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন। এ কক্ষে অন্যদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল কুদ্দুছ মাখন, আশাবুল হক এমপি ও মুরাদ জংয়ের বাবা এমপি আনোয়ার জং, দেলওয়ার এমপি, এ্যাডভোকেট দেলওয়ার, কোরবান আলী, শেখ আব্দুল আজিজসহ মোট ৮ জন।

    হত্যাকান্ডের রাতটা ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় ছিল। সেই বর্ণনা দিয়ে ষাটোর্ধ প্যাটেল বলেন, মেজর ডালিমসহ কয়েকজন আগেই রেকি করে গিয়েছিল নিউ জেল। আমরা তখন থেকেই শঙ্কা করছিলাম। ঘটনার দিন রাত ৩টা ১৭ মিনিটে পাগলা ঘণ্টি বেজে ওঠে। কারারক্ষীরাও অনবরত হুইসেল বাজাতে থাকে। এভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির এক পর্যায়ে চার জাতীয় নেতাকে ১ নম্বর কক্ষটিতে একত্রিত করা হয়। এক পর্যায়ে কানে আসে গুলির শব্দ। তখনই আশঙ্কা করেছিলাম- সব শেষ। পরের বর্ণনাটি আরও হৃদয় বিদারক। চোখ জলে ভিজে যায়। তিনি বলেন, রাতটা আল্লা আল্লা করে কাটিয়েছি। ভোরবেলায় সব নীরব। সামান্য আলো ফুটতেই হামাগুড়ি দিয়ে বারান্দার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি আমি। আর তখনই দেখি, আমাদের কক্ষের সামনের ড্রেনটি রক্তে ভেসে যাচ্ছে! চিৎকার করে কাঁদতে থাকি আমি। বাকিদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকি, নেতারা নেই। ওরা নেতাদের মেরে ফেলেছে। আমার চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে গ্রিলের কাছে আসেন। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন তারাও। মনে হচ্ছিল, কেয়ামত নেমে এসেছে। ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া প্যাটেল বলেন, যতদিন বেঁচে থাকব এই দৃশ্য আমি ভুলতে পারব না।

    মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কাছ থেকে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে দেখার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, হত্যা করার কিছুক্ষণ আগে কারারক্ষীরা তাকে আমাদের কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যায়। হাফহাতা হাল্কা গেঞ্জির ওপর পাঞ্জাবি পরে তিনি বের হয়ে যান। আমি তখন বলেছিলাম, লিডার, ওরা বোধহয় কোন কাগজপত্রে সাইনটাইন করাতে চাইবে। কিন্তু মনসুর আলীর চোখে মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে, তিনি মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই যাচ্ছেন।

    ঘাতকদের নির্মমতার বর্ণনা দিয়ে প্যাটেল বলেন, এম মনসুর আলী তখনও শহীদ হননি। পান করার জন্য পানি চাচ্ছিলেন। কারারক্ষীরা পানি দেয়নি। বরং কেউ একজন দৌড়ে গিয়ে অস্ত্রধারীদের খবর দেয়। তারা ফিরে এসে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এ সময় অন্য তিন নেতার শরীরেও বেয়নেট চার্জ করা হয়।

    কারাগারে থাকা অবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও কথা হয় প্যাটেলের। নেতার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, হত্যার আগের রাতে তাজউদ্দীন আহমদ স্বপ্নে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে নাকি টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যেতে এসেছিলেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মতোই হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

    কারাগারে এএইচএম কামারুজ্জমানকেও দেখেছেন প্যাটেল। প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, তিনিও অসাধারণ নেতা ছিলেন। ভাল মানুষ ছিলেন।

    এমন পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক এমন বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রাণ নেতাদের নির্মম মৃত্যু কাছ থেকে দেখার ঘটনাটিকে নিজের জীবনের চরম দুর্ভাগ্য বলে মনে করেন সাইদুর রহমান প্যাটেল। বলেন, একটু আপস করলেই প্রাণগুলো বেঁচে যেত। কিন্তু দেশপ্রেম আর নেতার প্রতি আনুগত্যের অনন্য দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রেখে যেতেই হয়ত মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন তাঁরা। আজকের রাজনৈতিক নেতারা যদি জাতীয় চার নেতার জীবন থেকে সামান্যতম শিক্ষাও নিতেন তাহলে দেশ আরও অনেক এগিয়ে যেত বলে মনে করেন সাইদুর রহমান প্যাটেল।সুত্র মোরসালিন মিজান কর্তৃক লিখিত জনকণ্ঠ থেকে।