জাফলং কোয়ারীতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে,প্রশাসন নির্ভিকার !

    0
    303

    রেজওয়ান করিম সাব্বির, জৈন্তাপুর (সিলেট) প্রতিনিধি: নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য নিয়ে কবি সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন শত সহ¯্র কবিতা গল্প আর গান। শিল্পী তার তুলির ছোয়ায় একেছেন ছবি, নৈস্বর্গীক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি প্রকৃতি কন্যা খ্যাত জাফলংয়ের। বিশেষত রূপের নগরী জাফলং ছিল সবুজের সমাহার আর ভ্রমন বিলাসীদের চোঁখ জুড়ানো অপরূপ দৃশ্য ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস জাফলং’র নৈসঙ্গিক সৌন্দর্য্য লীলাভূমিতে যন্ত্র দানব পেলোডার, এস্কেভেটর, বোমা মেশিন ও অপরিকল্পিত অবৈধ পাথর গর্ত সমুহ ক্রমশ বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি কন্যা খ্যাত পাহাড়’র বুক চিড়ে বয়ে আসা ঝর্ণার স্বচ্ছ জলরাশী, ঘুমন্ত পাথরের শো-শো শব্দ, ছোট ছোট পাহাড়ের অপরূপ শোভা।
    সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র জাফলংয়ের জিরো পয়েন্টের অদূরে অবৈধ ভাবে পাথর উত্তোলনের গর্তে পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে মাটি চাপায় শ্রমিক নিহত হয়। নিহত শ্রমিকের নাম আহম্মদ আলী(৫০) সে গোয়াইনঘাট উপজেলার ডৌবাড়ি ইউনিয়নের ঘোষগাঁও গ্রামের মৃত নূর মিয়ার ছেলে। এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়- গত ১০ ফেব্রুয়ারি রবিবার সন্ধ্যায় জাফলংয়ের জিরো সংলগ্ন একটি পাথর উত্তোলনের অবৈধ গর্তে পাথর সংগ্রহের কাজ করছিল শ্রমিকরা। হঠাৎ গর্তের পাড় ধষে পড়লে ঘটনাস্থল গুরুত্বর আহত হয় ১জন পাথর শ্রমিক। লোকজান জানার পূর্বেই পাথর খেকুরা আহত শ্রমিককে সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করে। এদিকে ঘটনার ১দিন পর পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গর্তের মালিক এরশাদ মিয়াকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করে। এ ঘটনায় সোমবার নিহত আহম্মদ আলীর স্ত্রী নাজমা বেগম বাদী হয়ে এরশাদ আলীকে প্রধান আসামি করে ৩ জনের নাম উল্লেখ পূর্বক অজ্ঞাত কয়েক জনকে আসামী করে গোয়াইনঘাট থানায় মামলা দায়ের করে।
    গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আব্দুল জলিল ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান নিহতে স্ত্রী বাদি হয়ে এজাহার দাখিল করেছে। তার অভিযোগটি আমলে নিয়ে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। উল্লেখিত আসামীদের মধ্যে ১জনকে আটক করা হয়েছে এবং বাকী আসামীদের আটকের তৎপরতা চলছে।
    সিলেটের প্রধান পর্যটন এলাকা জাফলং আদিকাল থেকে পর্যটকরা এক নজর দেখতে ছুটে আসে। বিশ^বিখ্যাত পর্যটকরা বাংলাদেশে ভ্রমনে আসলে একটু সময়ের জন্য জাফলং প্রকৃতি উপভোগ করেন। সবুজ পাহাড় গভীর অরণ্য আর সমতল ভূমির মিলন মেলা শুধু এখানেই দেখতে পাওয়া যায়। উচু নিচু পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে চলেছে ঝর্ণাধারা। দর্শনীয় স্থান হিসেবে জাফলং দেশি বিদেশি পর্যটকদের কাছে পরিচিত। অতি সম্প্রতি এক শ্রেণীর অর্থ লোভী মহলের প্ররোচনায় জাফলং এলাকায় টিলা ও সমতল ভূমি কাটার মত ঘৃন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে জাফলংয়েরর সৌন্দর্য্য। দিনের বেলা অথবা রাতের আধারে কতিপয় অসাধু পাথর ব্যবসায়ীরা ছোট-বড় বোমা মেশিন দিয়ে দাপটের সাথে পাথর উত্তোলন করে যাচ্ছে। এতে জাফলংয়ের পরিবেশের মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত উর্দ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রশাসনিক কাজের জটিলতা অর্থ্যৎ প্রয়োজন মত জনবল না থাকায় পুরো জাফলং এলাকা নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হচ্ছেনা। সাবেক বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খাঁন মেনন সম্প্রতি জাফলং পর্যটন মোটেল উদ্বোধন কালে জাফলংকে আরোও উপভোগ যোগ্য ভ্রমন স্থান হিসেবে গড়ে তোলা সহ পরিবেশ বিধংসী সকল কর্মকান্ড বন্ধের মাধ্যমে একটি আধুনিক মানের পর্যটন এলাকা গড়ার পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে আজও সেরূপ কোন পরিকল্পনা বাস্থবায়নের মুখ দেখেনি এ অ লের মানুষ। ২০০৭ সালে তত্তাবধায়ক সরকার আমলে সিলেট তামাবিল মহা-সড়কের দু-পাশের অসংখ্য ত্রুাশার মিল উচ্ছেদ করা হয় এবং রাস্তার দু-পাশে হাজার হাজার একর ভূমিতে বৃক্ষরোপণ করা হয়। তৎসময়ে সিলেট বনবিভাগের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় মনোরম গ্রীণপার্ক নামে একটি বিশাল প্রকল্প। এ প্রকল্পে অসংখ্য স্থাপনা নির্মিত হলেও রহস্যজনক কারণে এখন পর্যন্ত জনবল নিয়োগ সহ পরবর্তী কোন কার্যত্রুম চোখে পড়েনি, আর বিপরীতে যা ঘটল অর্থাৎ সামপ্রতিক সময়ে গ্রীণপার্কের এলাকাতেই আবার দাপটের সাথে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে গড়ে উঠছে ভূইফোড় মত ত্রুাশার মেশিন ও পাথর কয়লার ড্রাম্পিং ইয়ার্ড। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসা পর্যটকরা শুধু গ্রীণপার্কের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ফটোশেসন করতে দেখা মিলে। হয়ত কোন একদিন পর্যটকরা রঙ-বেরঙের পোষাক পরে মাইক বাজিয়ে জাফলং ভ্রমন থেকে মুখফিরে নেবে। নাগরিক জীবনের এক ঘোয়েমি থেকে ক্ষনিকের জন্য মুক্তি পেয়ে জাফলং ছুটে আসে অসংখ্য মানুষ। এক সময় ভ্রমন পিপাসুদের জন্য এলাকাটি ছিল অতি পছন্দের স্থান।

    মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরেজমিন জায়লংয়ের বুকে পায়ে হেঁটে জাফলংকে পর্যটন নগরী হিসাবে ঘোষনা করলেও অসাধু কর্মকর্তা ও অতি মুনাফা লোভী পাথর ব্যবসায়ীদের কারনে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনার পরও বাস্তবে কোন উন্নয়ন না হওয়াতে জাফলংএ বেড়াতে আসা পর্যটকদের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পর্যটন করর্পোরেশনের অর্থায়নে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ পালের তত্ত্বাবধানে দৃষ্টি নন্দিত সিড়ি পর্যটকদের হাটাচরার জন্য নির্মান করেন। মেঘালয়ের পাহাড় ঘেষে জাফলংএর নৈসর্গিক দৃশ্য এখন আর পর্যটকদের মন কাড়েনা, জাফলং এলাকার প্রকৃতির দৃশ্য ছোট ছোট টিলা, বনভুমি আর ফসলের মাঠ এখন পাথর খেকুদের নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে। তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে অতীত থেকে বসবাস করে আসা সাধারন মানুষ। ফলস্বরূপ হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ইতিহাস আর অপরূপ দৃশ্যাবলী। খুব শিঘ্রই যদি প্রাচ্যের রাণী নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য রক্ষায় সরকারী ভাবে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহন করা না হয়, তাহলে চির দিনের জন্য পাথর খেকুদের পেটে ঢুকে যাবে প্রকৃতিক কন্যা খ্যাত পর্যটন স্থানটি। জাফলং এলাকার নদী এবং বিভিন্ন পাহাড়-টিলা সহ বিভিন্ন জুম বাগান দখল করে অপরিকল্পিত ভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে যে কোন সময় পরিবেশের বিপর্যয় ঘটার আশংঙ্কা রয়েছে।
    ২০১৮ সনে ৬জন শ্রমিকের প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে শ্রমিক নিহতের সূচনা ঘটে, ২০১৯ সনে এসে ২জন শ্রমিক নিহত হওয়ার পর নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪ জনে। উত্তর পুর্ব সিলেটের বিভিন্ন এলাকা জুড়ে মাটির নিচে রয়েছে পাথরের বিশাল স্তর। যার কারনেই এলাকাটির প্রতি চোখ পড়ে অর্থ লোভী পাথর খেকু চক্রের যন্ত্র দানবের কাছে। পাথর খেকু বাহিনীতে রয়েছেন বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও ক্যাডার এবং প্রশাসন নিয়ন্ত্রণকারী দালাল চক্র। তাদের কাজ প্রতিবাদ কারীদেরকে হুমকি ধমকি দিয়ে ঠান্ডারাখা, আর কেউ বেশী বাড়াবাড়ী করলে তাদেরকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করে শায়েস্তা করা, প্রয়োজনে ভিটে মাটি ত্যাগ করে এলাকা থেকে বিতাড়িত করা। অপরদিকে শ্রমিকের দোহাই দিয়ে এই পাথরখেকু চক্র নিজেদের ফায়দা হাসিল করে সিলেট শহরে গড়ে তুলছে সুবিশাল অট্টলিকা। ভাসমান শ্রমিকরাও কেউই জাফলংয়ের স্থায়ী বাসিন্ধা নয়। তাদের বেশিরভাগ লোক সিলেটের বাহিরের বাসিন্ধা বিশেষ করে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও সুনামগঞ্জের।
    ২০১৮ সনের ৫ জানুয়ারী সিলেট চেম্বারের উদ্যোগে ট্যুর অপারেটরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) এর সাথে সিলেটের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও সম্ভাবনা শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য ইমরান আহমদ বলেছিলেন পর্যটন খাতের উন্নয়নে বর্তমান সরকার অত্যান্ত আন্তরিক। ইতিমধ্যে এখাতের উন্নয়নে অনেকগুলো পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। যেমন সরকার জাফলংয়ের রাস্তার উন্নয়নে ১৯০ কোটি টাকা একনেকে বরাদ্ধ দিয়েছে, এছাড়া জাফলং বিছনাকান্দি ট্যুরিষ্ট স্পট থেকে পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং নতুন কাউকে লীজ দেওয়া হয়নি। তিনি আরো বলেছেন পর্যটকদের টিকিয়ে রাখতে হলে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন। ২০১৯ সালের শুরুতেই জাফলংয়ের পাথর কোয়ারীর ব্যবসায়ীরা উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা নিয়ে কোয়ারীতে পাথর উত্তোলন শুরু করে। যেখানে উল্লেখ ছিল ম্যানুয়েল পদ্ধতি অনুসরন করে পাথর সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু পাথর ব্যবসায়ীরা আইনের প্রতি বৃদ্ধাআঙ্গুলী দেখিয়ে দিন-রাত সমান ভাবে যন্ত্রদানব পে-লোডার, এস্কেভেটর মেশিন দিয়ে অপরিকল্পিত ভাবে পাথর উত্তোলন শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়ন ঘটেই চলেছে আহত নিহতের মত দূর্ঘটনা। এলাকার সচেতন নাগরিক, পর্যটন প্রেমিক, পরিবেশবিদ সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে আলাপ কালে তারা বলেন, আমাদের দেশেরে প্রধানমন্ত্রী, পর্যটন মন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য’র চেয়ে এমন ক্ষমতাধর কোন ব্যক্তি রয়েছে জাফলং এলাকায় যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনা স্থানীয় প্রশাসন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
    এবিষয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিৎ পাল কাছে গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আব্দুল মালিক মালেক এর সাথে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, জাফলং পাথর ব্যবসায়ীরা আমাকে মৌখিক ভাবে অবহিত করেছে তাদের কাছে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা রয়েছে কোয়ারী থেকে পাথর উত্তোলনের জন্য। কোন ডকুমেন্ট এখন পর্যন্ত আমার কাছে দেয়নি। ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের মৌখিক নির্দেশনা থাকলেও কিভাবে ব্যবসায়ীরা যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলন করছে তা আমার জানা নেই। জাফলং এলাকার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অভিযান পরিচালনা করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনের প্রয়োজন পড়ে। আমার একারপক্ষে অভিযান পরিচালনা সম্ভব নয়।