চোরাকারকারীর স্বর্গরাজ্য জৈন্তাপুর-মেঘালয়

    0
    406

    চোরই পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ভারতীয় গরু-মহিষ

    রেজওয়ান করিম সাব্বির, জৈন্তাপুর সিলেট প্রতিনিধি: বাংলাদেশের জৈন্তাপুর ও ভারতের মেঘালয় সীমান্ত চোরাকারবারীদের স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে। প্রতিদিন রাতে সীমান্ত এলাকার চোরাই পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ভারতীয় গরু-মহিষ, মাদক সহ আমদানী নিষিদ্ধ নানা অবৈধ পন্য। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসেছে অবৈধ পশুরহাট। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহ স্থানীয় প্রশাসনের নিরব ভূমিকায় জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।

    অভিযোগ রয়েছে, চোরাকারবারীদের সাথে প্রশাসন সহ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি’র সখ্যতা রয়েছে। ৪৮বিজিবি’র শ্রীপুর, মিলাটিলা, ডিবির হাওড় ও ১৯ বিজিবি জৈন্তাপুর, লালাখাল ও সুরাইঘাট সীমান্ত ফাঁড়ির সদস্যরা মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে ভারতীয় অবৈধ পথে আসা গরু সহ পণ্য আটক করার কথা জানান। সম্প্রতি কয়েক মাস হতে শ্রীপুর, মিনাটিলা, ডিবির হাওড়, জৈন্তাপুর, লালাখাল সুরাইঘাট সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় গরু মহিষ মাদক সহ অবৈধ মালামাল প্রবেশ করছে বীরদর্পে।

    সিলেটের জৈন্তাপুর-ভারতের মেঘালয় সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় বিএসএফ ও বাংলাদেশের বিজিবি’র নজরদারি এড়িয়ে গরু চোরাকারবার ব্যবসা অব্যাহত রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় কর্তব্যরত বিএসএফ ও বিজিবি‘র সদস্যদের প্রত্যক্ষ ইশারায় সীমান্ত এলাকায় রাতের অন্ধকারে কিংবা দিনের আলোতে কারবার সংগঠিত হচ্ছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে। অবৈধ গরু ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

    প্রতিদিন জৈন্তাপুর উপজেলা সদরের পূর্ব বাজার, সিলেট তামাবিল সড়কের পাশে অবস্থিত দরবস্ত বাজার এবং হরিপুর বাজারে অবৈধ ভাবে নিয়ে আশা ভারতীয় গরু-মহিষের বাজার পরিচালনা করা হচ্ছে। উপজেলা সদরে ভারতীয় অবৈধ গরুর হাট উপজেলা প্রশাসন হতে মাত্র ১শত গজের মধ্যে অবস্থিত।
    সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত বাসিন্দাগন জানান, দিনের বেলায় সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন বাড়ীতে, জঙ্গলে, পাহাড় ও টিলার আড়ালে শত শত গরু-মহিষ বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকে। সন্ধ্যা রাত হতেই গভীর রাত পর্যন্ত জৈন্তাপুর উপজেলার আলুবাগান, শ্রীপুর, মিলাটিলা, ছাগল খাউরী, কাঠালবাড়ী, কেন্দ্রী হাওড়, ডিবির হাওড়, ডিবির হাওড় (আসামপাড়া), ঘিলাতৈল, ফুলবাড়ী গৌরীশংকর, কমলাবাড়ী, গুয়াবাড়ী, হর্নি, বাইরাখেল, জালিয়াখলা, কালিঞ্জীবাড়ী, লালাখাল গ্রান্ড, লালাখাল চা-বাগান, আফিফানগর চা-বাগান, বাঘছড়া, জঙ্গীবিল, তুমইর, ইয়াংরাজা, বালিদাঁড়া, বাঘছড়া, সিঙ্গারীপাড়, সুরাইঘাট এলাকা দিয়ে গরু মহিষ প্রবেশ করতে থাকে।

    তার মধ্যে আলুবাগান, শ্রীপুর, মিলাটিলা, ছাগল খাউরী, কাঠালবাড়ী, কেন্দ্রী হাওড় হয়ে আসা গরু মহিষ গুলো নলজুরী, আমবাড়ী বাওন হাওর ঢুলটিরপাড় রোড দিয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলায় প্রবেশ করে। ডিবির হাওড়, ডিবির হাওড় (আসামপাড়া), ঘিলাতৈল, ফুলবাড়ী গৌরীশংকর, কমলাবাড়ী, গুয়াবাড়ী, হর্নি, বাইরাখেল, জালিয়াখলা, কালিঞ্জীবাড়ী দিয়ে আসা গরু-মহিষ গুলো উপজেলা সদরের পূর্ব বাজার ও দরবস্ত বাজার প্রবেশ করে। লালাখাল গ্রান্ড, লালাখাল চা-বাগান, আফিফানগর, বাঘছড়া, জঙ্গীবিল, তুমইর, ইয়াংরাজা, বালিদাড়া, বাঘছড়া, সিঙ্গারীপাড়, সুরাইঘাট রোড দিয়ে আসা গরু গুলো হরিপুর বাজারে প্রবেশ করে।

    এছাড়া দ্রুত বহনের জন্য ছোট বড় পিকআাপ, ট্রাক গাড়ী দিয়ে সিলেট-তামাবিল হাইওয়ে রাস্তা হয়ে হরিপুর, দরবস্ত বাজার, কানাইঘাট-দরবস্ত রাস্তা দিয়ে দরবস্ত ও হরিপুর বাজার, চারিকাটা কেলেসিং বাজার টু দরবস্ত বাজার হয়ে দরবস্ত ও হরিপুর বাজার সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সীমান্ত এলাকার বাসিন্ধরা অভিযোগ করেন, প্রতিদিন রাতে আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে অবাধে গরু মহিষ সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর নজর এড়িয়ে অহরহ বাংলাদেশ প্রবেশ করছে। ভারতীয় বিএসএফ ও বাংলাদেশের বিজিবি’র নিষ্ক্রিয়তায় সীমান্ত এলাকায় জনমনে ক্ষোভ একত্রিভুত হচ্ছে।
    সূত্র মতে: আসাম-মেঘালয় সীমান্তবর্তী রংহংকং, মুক্তাপুর, আমলেরেং, হেওয়াই বস্তি, এসপিটিলা, চান্দঘাট, জালিয়াখলা, মালিডহর, দিগরখাল, আমকোনা, উসিয়াং, উখিয়াং ডুনা পাহাড়ি দূর্গম পথ অতিক্রম করে হাজার হাজার গরু-মহিষ অবৈধ ভাবে বাংলাদেশ প্রবেশ করে। সীমান্তের কোথায় নদী, পাহাড়, ঘন জঙ্গল ও কৃষি জমি, বিল ও খাল বেষ্টিত। পাহাড়ী এলাকা দিয়ে মেঘালয়ের পাচারকারীরা তাদের অপারেশন চালান।

    জৈন্তাপুর সীমান্তের গৌরীশংকর, ডিবির হাওর, গুয়াবাড়ী, লালাখাল, বালিদাঁড়া ও ভারতের মেঘালয়ের জোয়াই শহরের উমকিয়াং সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় রয়েছে কয়েকটি ছোট ছোট কালভার্ড। এই কালভার্ড ভারতীয় পাচারকারীদের আরও দিগুন সুযোগ করে দিয়েছে। উমকিয়াং সহ একাধিক স্থান দিয়ে সুকৌশলে ভারতীয় গরু মহিষ বাংলাদেশে পাচার করা হচ্ছে।
    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র সীমান্তের ওপারে গরু পাচারের বর্ণনা দিয়ে জানান, সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী ও পুলিশের নজর এড়াতে ছোট ছোট গাড়ি ব্যবহার করে থাকে। রাতে মেঘালয়ের জোয়াই-বদরপুর জাতীয় সড়কের পাশে অবস্থিত সীমান্তের বিভিন্ন বাড়িতে গরু-মহিষ পৌছে দেন একদল পাচারকারী।

    অনেক সময়ে বাজার হতে ক্রয় করা গরুর সাথে গ্রামের কৃষকের গরু চুরি করে সীমান্তের ১কিলোমিটার পর্যন্ত পৌছে দেয় চোরাকারবারীরা। তারা আরও জানান, মধ্যখানে হাত বদলের দায়িত্ব থাকে স্থানীয় কিছু দিন মজুর খাসিয়া যুবকদের হাতে। হাত বদল করে সেখান হতে আবার সময়-সুযোগ মত সীমান্তের কাছে নিয়ে যান অন্য দল।

    সীমান্তে পৌছে দেয়ার জন্য তাদের কে দেয়া হয় ৭শত থেকে ১হাজার টাকা। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় কয়েকটি বাড়ী ব্যবহার করে পাচারকারী দল। এই সব বাড়ীতে টাকার বিনিময় রাখা হয় গরু-মহিষ। পাহাড়ী এলাকায় গরুর উপর নম্বর দিয়ে চিহিৃত করা হয়। সীমান্তের ওপার-এপারে দাড়িয়ে থাকেন লাইনম্যানরা।

    মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে সমতলের চোরাকারবারীদের জানিয়ে দেওয়া হয় গরু ও মহিষের নাম্বর। ওপার হতে প্রথমে ১টা বা ২টা গরু সীমান্তের কাছে ছেড়ে দেয়া হয়। আর সীমান্তের এপারে থাকা চোরাকারবারী কাছে সংকেত চলে আসে।

    বিএসএফ‘র টহল নজরদারি একটু টিলে হলেও গরু মহিষের মূখে রশি দিয়ে বেঁধে জোড়ায় জোড়ায় ছেড়ে দেয়া হয়। গলায় ও মূখে ছোট ছোট করে বাঁধা থাকে রশি। যাতে করে নম্বর দেখে দ্রুত গরু মহিষ সরিয়ে নিতে সুবিধা হয়। এভাবে চলছে ভারতের মেঘালয়-বাংলাদেশের জৈন্তাপুর সীমান্তে ভারতীয় অবৈধ গরু মহিষ চোরাকারবারীদের রমরমা ব্যবসা। বিএসএফ ও বিজিবি‘র একাংশ সদস্যদের সাথে এপার ওপারের লাইনম্যানরা চুক্তি করে রাতে সীমান্ত পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশ প্রবেশ করে গরু মহিষ মাদক সহ নানান ধরনের অবৈধ মালামাল।

    বাংলাদেশ প্রবেশের পর সমতলের চোরাকারবারীদের লোকজন ৫শত থেকে হাজার টাকার বিনিময়ে গরু মহিষ গুলি পৌছে দেন গন্তব্য স্থালে। সেখান হতে হাত বদল হয়ে আবার ছোট ছোট পিকআাপ গাড়ী ব্যবহার করে বিভিন্ন হাট বাজারে পৌছে দেওয়া হয়। সম্প্রতি সময়ে জৈন্তাপুর-মেঘালয় সীমান্ত চোরাকারবারীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন রাতে জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে সিলেট তামাবিল হাইওয়ে সড়ক ব্যবহার করে বিজিবি ও প্রশাসনের বিনা বাঁধায় হাজার হাজার ভারতীয় গরু মহিষ ও মাদক দেশের বিভিন্ন স্থানে নেওয়া হচ্ছে।

    বাংলাদেশ প্রবেশ করার পর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মনোনিত লাইনম্যান কে গরু মহিষ প্রতি নির্ধারিত হারে চাঁদা টাকা পরিশোধ করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে গরু মহিষ পাঁচারের সুযোগ করে দেওয়া হয়। দিন দিন ভারতের মেঘালয়-জৈন্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন সীমান্তে চোরাকারবারীর দৌরাত্ব্য বেরে চলছে।