চুনারুঘাটে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বিষমুক্ত মাল্টা বাগান

    0
    807

    এম এস জিলানী আখনজী,চুনারুঘাট থেকে: হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে উৎপাদিত বিষমুক্ত নিরাপদ মাল্টা বাগান করার প্রতি ঝোঁক বেড়েছে এখানকার কৃষকদের। রোগ-বালাই কম থাকায় উৎপাদন ও লাভ বেশি, আর এসব করণেই দিন দিন এ অ লে মাল্টা চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গেল বেশ কয়েক বছর আগেও এ অ লে হাতেগোনা কয়েকটি মাল্টা বাগান ছিল। তবে মর্তমানে এর চিত্রটা পাল্টে গেছে। এ পর্যন্ত চুনারুঘাট উপজেলায় ১০ হেক্টর জমিতে মাল্টা আবাদ হয়েছে; এর মধ্যে ২০১৭ইং সালে স্থাপিত ৫০ শতকের একটি বাগানেই এ বছর ৪০মণ মাল্টা আবাদ হয়েছে।

    আগামী বছর ১০ হেক্টর জমিতে কয়েকগুন বেশি মাল্টা ফলনের আশাবাদী। এ বছরে উৎপাদিত মাল্টার খুছরা বাজার মূল্য প্রায় ২লক্ষ টাকা হবে। আগামী বছর কয়েকগুণ বেশি মাল্টা উৎপাদনের আশা করছে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। চুনারুঘাট উপজেলার ৩নং দেওরগাছ ইউনিয়নের ময়নাবাদ গ্রামের চন্দনা ব্লকের কৃষক শাহনুর রশিদ চৌধুরী তিন বছর আগে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে ২শ ২০টি বারি মাল্টা-১ জাতের কলমের চারা নিয়ে ৫০ শতাংশ জমিতে রোপন করেন। শাহনুর বলেন, ‘প্রথম বছর তেমন মাল্টা না হলেও দ্বিতীয় বছর ৫০ হাজারেরও বেশি টাকার মাল্টা বিক্রি করি।

    এ মৌসুমে ২শ ২০টি মাল্টা গাছে প্রচুর পরিমানের মাল্টা আসে। বর্তমান বাজারে চীন থেকে আমদানি করা মাল্টা ২শ’ থেকে ২শ’ ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ ওই মাল্টায় তেমন রসালো বা সুস্বাদু না। চুনারুঘাটে উৎপাদিত মাল্টা যেমন রসালো, তেমন সুস্বাদুও। তিন থেকে চারটি মাল্টায় এক কেজি ওজন হয়। সর্বনি¤œ ১শ’ থেকে ১শ’ ২০ টাকা কেজি দরে মাল্টা বিক্রি করলেও আমার এবছর দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকার মাল্টা বিক্রি করা সম্ভব হবে।’

    তিনি আরও বলেন, ‘চীনা থেকে আমদানি করা মাল্টায় ফরমালিন থাকে। আর আমাদের পরিশ্রমে উৎপাদিত মাল্টা সম্পূর্ণ বিষমুক্ত নিরাপদ ফল। গতবছর আমি এ বাগান থেকে বিষমুক্ত নিরাপদ কমলাও বিক্রি করেছি। এবছরও একইভাবে বাগান থেকে বিষমুক্ত মাল্টা ও কমলা বিক্রি করছি। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন যায়গা থেকে অনেকেই মাল্টা নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করছেন। আমি আশা করছি, আগামী বছরও আমার বাগানে তিনগুণ মাল্টা উৎপাদিত হবে। আর এতে করে আমার লাভের অংশও বেড়ে যাবে।’

    শাহানুর আরো জানান, তার বাগানের উৎপাদিত মাল্টা বিভিন্ন এলাকা থেকে চাষিরা এসে দেখে যান। ইতিমধ্যে তার দেখাদেখি এলাকার অনেকেই মাল্টা গাছ লাগিয়েছেন।

    তিনি বলেন, ‘এভাবে আমাদের দেখাদেখি মাল্টা চাষে ঝোঁক বাড়ছে অন্যদেরও। এরই ধারাবাহিকতা অব্যহত থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে চুনারুঘাট থেকে মাল্টা বিদেশসহ সারা বিশ্বে পাঠানো সম্ভব হবে।’

    কৃষি মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ আরিফুর রহমান অপু বলেন, সরকার কৃষি খ্যাতে বিভিন্ন উন্নয়নের যে কার্যক্রমগুলি নিচ্ছে, তা মূলত কৃষকদের অধিক লাভের জন্যই। এ মাল্টা বাগানটি মূলত ধানের জমি ছিল, এখানে ধান চাষ করা যেত। কিন্তু কৃষক উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে মাল্টার বাগান করেছে।

    তিনি বলেন, প্রতি ৫০ শাতাংশ জমিতে ২’শর মত মাল্টা গাছ লাগানো যেতে পারে। হাড়াই বছর বয়সী গাছগুলিতে যে পরিমাণের মাল্টা উৎপাদন হয়েছে তা ধানের চেয়ে ৪০গুনের বেশি এবং এখানে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে বিষমুক্ত মাল্টা উৎপাদন এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি, নিরাপ এবং পুষ্টিকর খাদ্য বাস্তবায়ন করতে হলে বিষমুক্ত খাদ্যের বিকল্প নেই।

    ইতিমধ্যে আমাদের দেশে পুষ্টিকর খাদ্য ধান ও আলু উৎপাদনে আমরা সক্ষমতা অর্জন করেছি। এখন আমাদেরকে পুষ্টিকর ফল ও অন্যান্য প্রটিন সমৃদ্ধ খাদ্যের দিকে নজর দিতে হবে। একইভাবে এটা যদি অর্তনৈতিক উন্নতির দিকে লাভবান হয় এবং আমরা যদি কৃষকদেরকে বুঝাতে সক্ষম হতে পারি তাহলেই এ পরিবর্তনটা করা সম্ভব হবে। তিনি এ বাগানটি পরিদর্শন করতে এসে কৃষকের ফলানো উৎপাদিত ফসল দেখে খুবই আনন্দি হন এবং তিনি আশা করেন অন্যান্য কৃষকরাও যাতে এ রকম মাল্টা বাগান করতে আগ্রহী হন।

    শুধু কৃষকই না যাদের বাড়ীর পাশে একটুকানি জমি আছে তারাও এই মাল্টা ও অন্যান্য ফলের বাগান লাগাতে পারেন এবং এতে করে অনেক লাভবানও হবেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেট অ লের অতিরিক্ত পরিচালক মোঃ শাহ জাহান বলেন, সিলেট অ লে শষ্যের নিবিরতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প থেকে আমরা প্রতি বছর সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় মাল্টা বাগানের আবাদ শুরু করেছি। তিনি বলেন, ময়নাবাদ গ্রামের শাহনুরের বাগানটি ৩য় বছর, এখানে এবছর প্রচুর পরিমানে গাছে ফল আসছে।

    এক সময় আমরা জানতাম যে, শুধু এ এলাকায় কমলা চাষ হয়। কিন্তু এখন এর বিপরীতে সিলেট অ লের চারটি জেলাতেই মাল্টার আবাদ খুবই ভালো হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হবিগঞ্জ জেলার উপ পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমাদের দেশ যেহেতু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এ জন্য সরকার খাদ্য শষ্যের পরিবর্তে উচ্চ মূল্যের ফসল যেগুলো আছে যেমন, মাল্টা, কমলা, তরমুজ ও বার মাসের তরমুজসহ অন্যান্য ফল সমূহ উৎপাদনের দিকে নজর দিচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা আমাদের একটি প্রজেক্ট ছিল শষ্যের নিবিরতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প সিলেট অ ল। সে প্রজেক্টের মাধ্যমে ৫০ শতাংশ জমির উপর আমরা একটি মাল্টা প্রদর্শনী দেই।

    তিনি বলেন এখন ঐ মাল্টা বাগানের গাছগুলোতে বিপুল পরিমানের ফসল আসছে। তিনি আশা করছেন এ বাগানের সফলতা দেখে আশপাশের সকল কৃষকও অনুপ্রাণীত হবেন এবং আমাদের চুনারুঘাট উপজেলাসহ হবিগঞ্জ জেলায় মাল্টাসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনের সফলতা নিয়ে আসবে। উপজেলা কৃষি অফিসার জালাল উদ্দিন সরকার বলেন, হবিগঞ্জ জেলার মধ্যে মাল্টা উৎপাদনে চুনারুঘাট এগিয়ে। এখানে এবছর ১০ হেক্টর জমিতে ৪০মণ মাল্টা উৎপাদন হয়েছে। মাল্টা চাষে ১ম অবস্থানে চুনারুঘাট উপজেলা। তিনি আরও জানান, একটি বাগানে ৫০শতক জমিতে বছরে তিন বার ধান চাষ করলে লাভ হতো ১৪ হাজার টাকা।

    কিন্তু একই পরিমাণ জমিতে মাল্টা চাষ করলে লাভ পাওয়া যাবে ১লক্ষ ৫০হাজার টাকা।’ ১০ বছরে একই পরিমাণ জমিতে ধান চাষ করলে আয় হবে ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। যেখানে একই পরিমাণের জমিতে মাল্টা চাষ করলে ১০ বছরে আয় হবে ৫৪ লক্ষ টাকা। ধান চাষ থেকে মাল্টা চাষে লাভবান হওয়া যাবে ১০ বছরে ৪০ গুণ বেশি। মাল্টায় তেমন কোনও রোগ-বালাই নেই বলেও জানান তিনি। এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশী কমলা গাছের সঙ্গে কলম করে বারি-১ জাতের মাল্টা গাছ লাগানো যায়। দুইবছর পরিচর্যার পর ওই গাছে বিপুল পরিমাণ মাল্টা ধরে। এ কারণে বাড়ছে মাল্টার বাগান। আমরা আশা করছি আগামী বছর দ্বিগুণ জমিতে মাল্টা উৎপাদন হবে।’

    তিনি আরও বলেন, সিলেট অ লে শষ্যের নিবিরতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় চারা, স্যার, বেড়া ও আনুষাঙ্গিকসহ অন্যান্য খরছ কৃষকদেরকে প্রদান করা হয়েছে। তিনি বলেন আগামী বছর ৭০থেকে ৮০মণ মাল্টা উৎপাদন করা সম্ভব হবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা হবে। চুনারুঘাটে এরকম আরও ১শ’ টিরও বেশি মাল্টা বাগান রয়েছে।