গুন্ডে ছবিটি প্রত্যাহারের জন্য প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে

    0
    232

    আমারসিলেট24ডটকম,২২ফেব্রুয়ারীঃ বলিউডের বিতর্কিত ছবি গুন্ডেতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করায় ছবিটির পরিচালক ক্ষমা চাইলেও বাংলাদেশে বইছে প্রতিবাদের ঝড়। দাবি উঠেছে ছবিটি প্রত্যাহারের। তরুণ সমাজের প্রতিবাদে মুখে পড়া এ ছবিটি ইতিমধ্যে তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ক্ষমা চেয়েছে। তবে ক্ষমা চাওয়ার পরও বাংলাদেশে ঝড় বইছে প্রতিবাদের। অনলাইনে প্রতিবাদের সঙ্গে দাবি তোলা হচ্ছে গুন্ডে ছবিটি প্রত্যাহারের। গুন্ডেতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারাও। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, যে পরিচালক এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন তার ইতিহাসের জ্ঞানের অভাব রয়েছে।

    এই চলচ্চিত্রের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী একাত্তরে আমাদের মিত্র বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। এর বেশি কিছু নয়। চলচ্চিত্রটি সংশোধন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।  বলেন, তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভালভাবে জানতে হবে। যাতে করে এসব চলচ্চিত্র তাদের বিভ্রান্ত না করতে পারে। বাংলাদেশ সরকার এ চলচ্চিত্রের বিষয়ে তাদের মত করে পদক্ষেপ নিতে পারে। তার সংগঠনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নিন্দা জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি। মুক্তিযোদ্ধা এ এস এম শহীদুল্লাহ খান বাদল ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের প্রচণ্ডভাবে সহায়তা করেছে এটা সত্য।

    কিন্তু বাংলাদেশ সকলের প্রচেষ্টায় স্বাধীন হয়েছে। এটা কেউ তৈরী করে দিয়ে যায়নি। ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সরকারকে এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। আমরা প্রতিবাদ না করলে ছবিটা আজীবন থেকে যাবে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো।মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান রয়েছে এটা সত্য। এ বিষয়ে ডকুমেন্ট রয়েছে। ছবি বানিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসকে বদলানো যাবে না। ইতিহাস তার আপন গতিতে চলবে। এটা কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না।এদিকে ছবিটি নিয়ে অব্যাহত প্রতিবাদের মুখে যশরাজ ফিল্মস ক্ষমা চেয়েছে।

    তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পাতায় এক বার্তায় বাংলাদেশী নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ‘প্রিয় বন্ধুরা, আমাদের ছবিতে যেভাবে গল্প তুলে ধরা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অনেক ভাই তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। ছবিটির কাহিনী ও গল্প পুরোপুরি কাল্পনিক। কোন জাতি, সমাজের বিশেষ কোন গোত্র কিংবা কোন ব্যক্তির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের অভিপ্রায় আমাদের ছিল না। তারপরও বাংলাদেশী ভাইরা যদি আমাদের কাজ দেখে আহত হন কিংবা অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে করেন তাহলে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি আমরা। এতে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। এটা কখনই ভুলার নয়। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।

    বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, যা-ই হোক, ‘গুন্ডে’ ছবিতে কোনভাবেই বাংলাদেশীদের মহান আত্মত্যাগের বিষয়টিকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়নি। আর ইতিহাস বিকৃতির তো প্রশ্নই ওঠে না। এর কাহিনীতে কেবল দেখানো হয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক পরিবার ও মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য হতে হয়েছিল। ছবিতে এমনই একটি পরিবারের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এদিকে ফেসবুকে ক্ষমা চাইলেও গুন্ডে নিয়ে বাংলাদেশে প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে অনলাইনে তরুণদের প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। দাবি উঠেছে ক্ষমা নয় ‘গুন্ডে’ প্রত্যাহারের। ‘গুন্ডে’ ছবির শুরুর দিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন চিত্র দেখানোর পাশাপাশি হিন্দি ভাষায় বলা হয়, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ শেষ হয়। ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা হিন্দুস্তানের সেনাদের সামনে আত্মসমর্পণ করেন।

    জন্ম হয় এক নতুন দেশ, বাংলাদেশ। হিন্দিতে আরও বলা হয়, যখন হিন্দুস্তানের সেনারা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছিলেন, তখন কাঁটাতারের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল ১১-১২ বছরের দুই অনাথ বন্ধু বিক্রম ও বালা। তারা বুঝতে পারছিল না, তাদের সঙ্গে যা হলো তা কি ঠিক ছিল, নাকি ভুল। নতুন দেশ কি তাদের নতুন জীবন দেবে? ছবিটির শুরুর দৃশ্যে দেখানো হয়, ভারতীয় যোদ্ধাদের সামনে আত্মসমর্পণ করছেন পাকিস্তানি সেনারা।  আর জন্ম হচ্ছে বাংলাদেশের। পেছনে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর পোস্টার। উদ্বাস্তু শিবিরের সামনে দিয়ে রুটি ছুড়তে ছুড়তে চলেছে ত্রাণের গাড়ি, আর কাদামাটি থেকে তা কুড়িয়ে খাচ্ছে অসহায় মানুষ।

    ‘গুন্ডে’ ছবিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখানো হলেও কোথাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হয়নি। আলী আব্বাস জাফর পরিচালিত যশরাজ ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত ওই চলচ্চিত্রটি ১৪ই ফেব্রুয়ারি হিন্দির পাশাপাশি কলকাতায় বাংলা ভাষায়ও মুক্তি পায়। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পরই সমালোচনা শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করার অভিযোগে। কলকাতা প্রতিনিধি জানান, ভারতের অন্যতম বৃহৎ প্রযোজনা সংস্থা যশরাজ ফিল্মের তৈরি দ্বিভাষিক ‘গুন্ডে’ ছবিতে যেভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে তা নিয়ে কোন হেলদোল নেই পশ্চিম বঙ্গে।

    ভারতের সেন্সর বোর্ডও যে বিষয়টিতে নজর দেয়নি তা স্পষ্ট হয়েছে সেন্সর বোর্ডের পূর্বাঞ্চলের এক সদস্যের কথায়। এপারে যারা ছবিটি দেখেছেন তারাও এই ইতিহাস বিবৃতির বিষয়ে মোটেই সচেতন বলে তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। উত্তর ২৪ পরগণার হাবড়ায় বাংলা ‘গুন্ডে’ ছবি দেখে বেরোনোর পর মধ্যবয়সী দর্শক বীরেন্দ্র নাথ দে-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল গুন্ডে ছবিতে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিকৃত তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে সেটা কি তিনি লক্ষ্য করেছেন? উত্তরে তিনি জানান, তেমন বিষয়ে তিনি নজর দেননি। তবে বিকৃতির ঘটনাটি শোনার পর অবশ্য তিনি জানিয়েছেন, এমন বিকৃতি হওয়া উচিত নয়।

    বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার আবেগকে উস্কে দিয়েই বাণিজ্যিকভাবে গুন্ডে ছবির শুরুতে বাংলাদেশের জন্মের কাহিনী বলা হয়েছে। আর তাই সেই স্মৃতি উস্কে দিয়ে ছবিটি বাংলায় ডাবিং করে পশ্চিমবঙ্গেই প্রথমে হিন্দির পাশাপাশি মুক্তি দেয়া হয়েছে। ছবির প্রোমো দেখে মনে হয়েছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছবিটিতে একটা বড় স্থানে রয়েছে। কিন্তু মুক্তির পর দেখা গেছে, গুন্ডে আসলে মুম্বাই মার্কা একটি থ্রিলার ছবি ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রশ্ন উঠেছে পরিচালক আলি আব্বাস জাফর এই ইতিহাস পেলেন কোথা থেকে? ভারতের সরকারি নথিতেও তো এমন তথ্য নেই। অথচ পরিচালক জাফর এই ইতিহাস বিকৃতির কথা মানতে রাজি হননি। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এই ছবি তৈরি করা হয়েছে একেবারেই ভারতীয় দৃষ্টিকোন থেকে।

    গুন্ডে ছবি বাংলা ডাবিং করা মুক্তি দেয়ার প্রতিবাদে টলিউডের অভিনেতা থেকে শুরু করে প্রযোজকরা পর্যন্ত একজোট হয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। খোদ রানীগঞ্জ কয়লা অঞ্চলের বিশিষ্ট নাগরিকরাও পর্যন্ত ছবিতে যেভাবে কয়লা অঞ্চলের সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে অবাস্তবভাবে কয়লা মাফিয়াদের কীর্তিকলাপ দেখানো হয়েছে তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বলিউডের মাধ্যমে বারবার দুর্গাপুর-রানীগঞ্জের মাফিয়াদের লড়াই আর কয়লা পাচারের স্বর্গরাজ্য হিসেবে দেখানোর প্রতিবাদ জানানোর কথাও ভাবছেন সেখানকার বিশিষ্টজনরা।মানবজমিন