গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টিঃএনডিএফ

    0
    237

    “নির্বাচন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত নয়,বরং গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি”

    আমারসিলেট24ডটকম,২৬ডিসেম্বরঃ  উপমহাদেশের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা কমরেড আবদুল হক-এর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ মৌলভীবাজার জেলা শাখা আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন দেশ আজ এক গভীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক তথা সামগ্রিক সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। শ্রমিক-কৃষক-জনগণ সা¤্রাজ্যবাদ ও তার দালাল এদেশীয় শাসক-শোষক গোষ্ঠীর তীব্রতর শোষণ-লুন্ঠন, নির্যাতন এবং ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী মহাজোট সরকারের দুঃশাসনে পিষ্ট হচ্ছে জনজীবন। এর উপর মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে সামরাজ্যবাদী পরিকল্পনায় ক্ষমতা ও গদি নিয়ে সামরাজ্যবাদের দালাল দলগুলোর মধ্যে কামড়াকামড়ি, খেয়োখেয়ি, সংঘাত-সংঘর্ষ আর এর ফলে প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছে নিরিহ জনগণ, শ্রমিক হারাচ্ছে জীবন-জীবিকা, কৃষক হারাচ্ছে তার উৎপাদিত ফসলের ন্যূনতম মূল্য। প্রভূ সামরাজ্যবাদের আশীর্বাদ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন মহজোট সরকার যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে চাচ্ছে। আবার বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। উভয় জোটই শ্রমিক-কৃষক-জনগণের জীবন-জীবিকা ও জাতীয় জীবনের মূল সমস্যা আড়াল করে তাদের হীন শ্রেণীস্বার্থ চরিতার্থ করে যাচ্ছে। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ভূরাজনৈতিক ও রণনীতিগত গুরুত্বপুর্ণ বাংলাদেশকে নিয়ে সামরাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর হয়ে চলছে। বাজার ও প্রভাববলয় পূণর্বন্টনকে কেন্দ্র করে সামরাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও শক্তি সম্পর্কে পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের রাজনীতিতে। এরকম পরিস্থিতিতে সা¤্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণে যে নামে বা যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক না কেন, আর তাতে যে দল বা জোটই ক্ষমতায় আসুক না কেন জনগণের তাতে কোন লাভ নেই। নির্বাচন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত নয়; বরং গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি। তাই কমরেড আবদুল হকের দেখিয়ে দেওয়া পথে সা¤্রাজ্যবাদ, সামান্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রাম অগ্রসর করে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করি। ২৫ ডিসেম্বর বিকেলে সংগঠনের চৌমুহনাস্থ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন এনডিএফ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোঃ নুরুল মোহাইমীন। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনডিএফ নেতা নজমুল হক চৌধুরী আফজাল, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি কবি শহীদ সাগ্নিক। আলোচনা সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এনডিএফ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস, ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অমলেশ শর্ম্মা, জাতীয় ছাত্রদল জেলা কমিটির আহবায়ক নুর মোহাম্মদ তারাকী ওয়েছ, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এখলাছুর রহমান সোহেল, মৌলভীবাজার জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন রেজিঃ নং চট্টঃ ২৩০৫ এর সভাপতি মোঃ মোস্তফা কামাল, সহ-সভাপতি মোঃ আজিজ মিয়া, রিকশা শ্রমিক সংঘ জেলা কমিটির সভাপতি সোহেল আহমেদ, সদস্য কিছমত মিয়া, হোটেল শ্রমিক নেতা তারেশ বিশ্বাস সুমন, রহুল আমিন, বিপুল কান্ত দাশ প্রমূখ। সভায় বক্তারা কমরেড আবদুল হকের রাজনৈতিক জীবনের উপর আলোচনা করে বলেন কমরেড আবদুল হক ১৯২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর যশোর জেলার সদর থানার খড়কির সামন্তবাদী পীর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে তিনি এন্ট্রাস পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৭ম স্থান অধিকার করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীতে ১ম স্থান অর্জন করেও ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার পিছনে না ছুটে পার্টির আহবানে কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং ১৯৪১ সালে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির প্রার্থী সভ্য পদ লাভ করেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিচালিত ছাত্র সংগঠন অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশনের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪১ সালে যশোর জেলার বনগাঁয়ে তৃতীয় কৃষক সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এই সম্মেলনে “লাঙ্গল যার জমি তার” এবং ঐতিহাসিক তে-ভাগা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তান কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কমরেড আবদুল হক ছিলেন সুবক্তা। ১৯৭০ সালের ২০ জানুয়ারী আসাদ দিবসে ভাসানী ন্যাপ আয়োজিত ঢাকার পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক লোকের জনসভায় তাঁর অসাধারণ বক্তৃতা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৩৯ সালে হলওয়ের মনুমেন্ট ভাঙ্গার আন্দোলন, ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলন,  ১৯৪৪ সালে হাটের তোলা আদায় বন্ধ আন্দোলন, ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ড আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গনঅভ্যূত্থানসহ বাংলাদেশের বিপ্লবী আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন। কমিউিনিষ্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সংশোধনবাদের সকল প্রকাশের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের লাল পতাকা সমুন্নত রেখেছেন। ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদী ‘তিন শান্তি’ তত্ত্ব, চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির তিন বিশ্বতত্ত্বের বিরুদ্ধে কমরেড আবদুল হক পরিচালনা করেন দৃঢ় মতাদর্শগত সংগ্রাম। তিনি বরাবরই শান্তিপূর্ণ পার্লামেন্টারি পথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংশোধনবাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগে ক্ষমতা দখলের মার্কসাবাদী লেনিনবাদী নীতি উর্ধ্বে তুলে ধরেন। কমরেড আবদুল হক তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন বিপ্লবীদের মৃত্যু নেই। লেখক হিসেবে কমরেড আবদুল হক ক্ষুরধার লেখনির অধিকারী ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো ইতিহাসের রায় সমাজতন্ত্র, ক্ষুধা হইতে মুক্তির পথ, যত রক্ত তত ডলার, পূর্ব-বাংলা আধাউপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী, কৃষি ব্যবস্থা আধাসামন্ততান্ত্রিক, মার্কসীয় দর্শন, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ-১, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ-২, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনীতি ও মাওসেতুং এর মূল্যায়ন। এই দশটি গ্রন্থের সমন্বয়ে কমরেড আবদুল হক গ্রন্থাবলী ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। সুদীর্ঘ ৬০ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে ২৫ বছরই তাঁকে আত্মগোপনে কাটাতে হয়। ১৯৯৫ সালের ২২ ডিসেম্বর ৭৫ বছর বয়সে মহান এই বিপ্লবী নেতা মৃত্যুবরণ করেন।