কোনো একটা সম্পর্ক কি আমাদের মধ্যে রাখা যায় নাঃভুট্টো

    0
    680

    বিমানের সিঁড়িতে ভুট্টো খুব নরম সুরে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘কোনো একটা সম্পর্ক কি আমাদের মধ্যে রাখা যায় না?’ বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর দিকে বিচলিত হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখো ভুট্টো! আমি এইসব নিয়ে এখন একদমই আলোচনা করতে চাই না। তোমার যা প্রস্তাব আছে সেটার উত্তর আমি বাংলাদেশের মাটিতে নামার সাথে সাথে তোমাকে দিবো।’

    ৮ জানুয়ারী ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌছালেন। বিমান থেকে নামার সাথে সাথে এয়ারপোর্টে লাউডস্পিকারে বলা হলো, ‘Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman is here.’

    বঙ্গবন্ধু তখনো বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান না। কিন্তু তাকে রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদায় হিথ্রো এয়ারপোর্টের ভি.আই.পি লাউঞ্জে নেওয়া হলো। ভি.আই.পি লাউঞ্জের প্রধান দরজায় একজন ব্রিটিশ রয়েল গার্ড দাঁড়িয়ে থাকেন। এই রয়েলগার্ড স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে থাকে এবং কোনোরকম নড়া-চড়া করার নিয়ম নেই। কিন্তু সেদিন রয়েল গার্ড নিয়ম ভঙ্গ করে এক পা বাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট দিয়ে বললেন, ‘Sir, we have been praying for you.’

    বঙ্গবন্ধু রয়েল গার্ডের কাধে হাত রেখে মুচকি হাসি দিলেন। রয়েল গার্ডের চোখে পানি রীতিমত টলমল করছিলো।

    ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে বললেন, ‘আপনাকে আমরা রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মাননা দিচ্ছি। তাই রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তায় আপনাকে ক্ল্যারিজ হোটেলে থাকতে হবে।’

    বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, ‘আমি তো রাসেলস স্কয়ারে ছোট হোটেলগুলোতে থাকতাম। ওখানে বাঙালিরা সহজে আসতে পারে। আমাকে রাসেলস স্কয়ারে ব্যবস্থা করে দাও।’

    হিথ উত্তর দিলো, ‘দেখো তুমি তো হেড অফ স্ট্রেট হিসাবে আমাদের অতিথি। তোমার সব কথা আমরা মানার চেষ্টা করবো। কিন্তু এই কথাটা মানতে পারবো না। কারণ হেড অফ স্টেটের নিরাপত্তা শুধুমাত্র ক্ল্যারিজেজ হোটেলেই হয়।’

    বঙ্গবন্ধু ক্ল্যারিজ হোটেলে পৌঁছালেন। তাকে রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদায় গার্ড অফ অনার দেওয়া হলো। বিকাল গড়াতেই ক্ল্যারিজ হোটেলের সামনে লোক সমাগম হতে শুরু করলো। সাধারণত ক্ল্যারিজ হোটেলের সামনে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি নিষিদ্ধ। কিন্তু সেদিন ক্ল্যারিজ হোটেলের সামনে এতো লোকের সমাগম হয়েছিলো যা ইতিহাসের বাইরে।

    বঙ্গবন্ধু হোটেলে পৌছে প্রথমে বাংলাদেশে ফোন দিলেন অস্থায়ী প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদকে। তাজউদ্দীনকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার দেশের মানুষ কেমন আছে?’

    তাজউদ্দীন উত্তর দিলেন, ‘লিডার আমরা সবাই ভালো আছি। কিন্তু দেশের মানুষের একটাই প্রশ্ন বঙ্গবন্ধু কোথায়? বঙ্গবন্ধু কবে দেশে আসবেন? আপনার জন্য সারা দেশের মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছে।’

    ৯ জানুয়ারি ১৯৭২, প্রধানমন্ত্রী হিথ স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলেন। বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘দেখো আমরা খুবই আনন্দিত তুমি রাষ্ট্রপতি হিসাবে প্রথম আমাদের দেশে এসেছো। আমরা তোমাকে সমস্ত সাহায্য সহযোগিতা করবো। কিন্তু এই মূহুর্তে তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলো।’

    বঙ্গবন্ধু জবাব দিলেন, ‘আমি দেশে ফিরে যেতে চাই। আমাকে যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করে দাও।’

    হিথ সঙ্গে সঙ্গে তার সেক্রেটারিকে বললো, ‘দেখো উনাকে ফেরানোর জন্য দ্রুত কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা?’

    সেক্রেটারি জানালো, ‘ব্যবস্থা আছে কিন্তু দুই-তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে।’

    এবার হিথ বললেন, ‘উনাকে আমার ব্যবহৃত রাষ্ট্রীয় বিমানের ব্যবস্থা করে দাও।’

    ১০ জানুয়ারী ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্সের নিরাপত্তায় দেশে ফিরলেন। যা ব্রিটিশ ইতিহাসে কখনো কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য করা হয়নি।

    বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে ভুট্টোর সেই কথার জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ ভুট্টো তোমার সাথে সম্পর্ক? দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক থাকে সেই সম্পর্ক থাকবে। তুমি তোমার দেশ নিয়ে সুখে থাকো ।

    আজ ১০ জানুয়ারী, পাকিস্তানের বন্দী কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রিয় স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কারাগারে থাকতে বারবার বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি তোমারা মেরেও ফেলো তবু আমার লাশটা প্রিয় বাংলাদেশের মাটিতে পৌঁছে দিও তোমরা।