আম্পানের হামলায় বাংলাদেশে ৭ ভারতে ১২ জনের মৃত্যু

    0
    233

    সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের উপকূলে আছড়ে পড়া সুপার সাইক্লোন আম্পানের প্রভাবে নারী-শিশুসহ সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। পটুয়াখালীতে শিশুসহ দুজন, ভোলায় এক বৃদ্ধ, সাতক্ষীরায় এক নারী, পিরোজপুর এবং বরগুনায় অপর দুই ব্যক্তি মারা যান।অপরদিকে প্রতিবেশী দেশ কোলকাতায় তিনজনসহ বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে অন্তত ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

    বুধবার রাত ৯টা ৮ মিনিটে ঘণ্টায় ১৪৮ কিলোমিটার বেগে সাতক্ষীরায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এর আগে, সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিট থেকে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানা শুরু করে। আম্পানের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক ঘর-বাড়ি ও গাছপালা ভেঙে পড়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ছে। কিছু কিছু জায়গায় গাছ পড়ে সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁচা ঘর ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অবকাঠামো। কয়েক ফুট বেড়েছে নদনদীর পানি। অনেক স্থানে নদীর পানি প্রবল বে‌গে আছড়ে পড়ছে বে‌ড়িবাঁধের ওপর।

    আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ রাত সাড়ে ১০টার দিকে জানান, উপকূল অতিক্রমরত ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করে বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বৃষ্টি ঝড়িয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে যেতে পারে বলে তিনি জানান।

    নারী-শিশুসহ নিহত ৭

    পটুয়াখালী : বুধবার সন্ধ্যায় পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি এলাকায় ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙ্গে পরে রাশেদ নামে ছয় বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

    অপরদিকে, জনসচেতনতামূলক প্রচারকাজ চালাতে গিয়ে কলাপড়ার ধানখালীর ছৈলাবুনিয়া এলাকায় খালে নৌকাডুবে শাহ আলম নামে দুর্যোগ প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) এক সদস্যের মৃত্যু হয়েছে।

    ভোলা: আম্পানের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ে ভোলার চরফ্যাশনের দক্ষিণে একটি গাছ ভেঙে চাপা পড়ে ছিদ্দিক ফকির (৭০) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার (২০ মে) দুপুরে উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার প্রধান সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

    নিহত ছিদ্দিক ফকির ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার শশীভূষণ থানার চর মানিকা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের চর কচ্ছপিয়া গ্রামের বাসিন্দা।

    দক্ষিণ আইচা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুন অর রশিদ জানান, সকালের দিকে ওই বৃদ্ধ বয়স্ক ভাতা আনার জন্য ভাড়া করা মোটরসাইকেলে উপজেলা সদর চরফ্যাশনের দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় ঝড়ে একটি গাছ ভেঙে তার ওপর পড়ে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

    অপরদিকে, সদর উপজেলার ইলিশা রাজাপুর ঘাটে ট্রলার ডুবে রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এনায়েত হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

    সাতক্ষীরা: ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াতে গিয়ে গাছের ডাল ভেঙে সাতক্ষীরা শহরের সংগীতা মোড় এলাকায় করিমুন্নেসা নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার রাত ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত নারী শহরের কামালনগর এলাকার বাসিন্দা।

    সাতক্ষীরা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্তর কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান বলেন, ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াতে গিয়ে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে ওই নারীর মৃত্যু হয়।

    পিরোজপুর: পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় দেওয়া ধসে শাহজাহান মোল্যা (৬০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। মঠবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুদুজ্জামান ঢাকা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

    বরগুনা: বরগুনা সদর উপজেলার পরীরখান বাজার এলাকায় জোয়ারের পানিতে ডুবে মো. শহীদ (৬০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ ঢাকা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

    ঘূর্ণিঝড় আম্পানে উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রাত কাটাচ্ছেন বলে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

    আম্পানে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ৩৩ লাখ মানুষ

    বিআরইবি-এর চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মইনউদ্দিন জানিয়েছেন, আম্পানের কারণে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও লক্ষ্মীপুরের প্রায় ৩৩ লাখ পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আছেন। বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপনের কাজ চালু থাকলেও, সাতক্ষীরা ও খুলনায় প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে সমস্যা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

    এ ছাড়া, বরিশাল শহরসহ বিভাগের প্রায় তিন লাখ গ্রাহক বিদ্যুতবিহীন অবস্থায় আছে বলে জানিয়েছেন পশ্চিম জোন বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির নির্বাহী প্রকৌশলী অমূল্য কুমার সরকার।

    বাংলাদেশ থেকে সরে গিয়ে ভারতে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে রাজধানী কোলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্র উপকূলীয় কয়েকটি জেলা। এরমধ্যে দুই ২৪ পরগনা এবং দুই মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলির অবস্থা ভয়াবহ। কোলকাতা তিনজনসহ বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে অন্তত ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

    দিল্লির আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিতে অতি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়টি আছড়ে পড়ে। সে সময় ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণনের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৫৫-১৬৫ কিলোমিটার। আর সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার ছিল। সন্ধ্যা ৭টা বেজে ২০ মিনিটে কোলকাতায় সেই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৩৩ কিলোমিটার।

    একটানা তিন ঘণ্টা আম্পানের তাণ্ডব চলার পর রাত ৯টা নাগাদ নবান্নে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘দুই ২৪ পরগনা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, বাড়িঘর, নদী বাঁধ ভেঙে গিয়েছে, ক্ষেত ভেসে গিয়েছে। পাথরপ্রতিমা, নামখানা, বাসন্তী, কুলতলি, বারুইপুর, সোনারপুর, ভাঙড় থেকে যা খবর এসেছে তা ভয়াবহ।”

    মমতা বলেন, “বারাকপুর, বারাসত, বসিরহাট ও গঙ্গাসাগর সাব ডিভিশন, হাওড়া, হুগলি, দুই মেদিনীপুরের অবস্থাও খুব খারাপ। রাস্তাঘাট সবই প্রায় বন্ধ। এখনও আমি ভাবতে পারছি না সবকিছু ঠিক কী করে করব? যা খবর পাচ্ছি তাতে সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। এত ঝড় হবে কেউ ভাবতে পারেনি। আবহাওয়াবিদরাও বুঝতে পারেননি।”

    ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবাই বাংলার পাশে এসে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সবার কাছে আবেদন করব এই সময়ে বাংলার পাশে এসে দাঁড়ান। দয়া করে এখন রাজনীতি করবেন না। রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রমের কাছে ভয়াবহ এই সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ করব। আমাদের সব পঞ্চায়েতগুলিকেও এই কাজে মনোনিবেশ করতে বলব।”

    আম্পানের ভয়াবহতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘আজকে যেটা হল তা ১৯৩৭ সালের কথা মনে করিয়ে দিল। কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আজকে যে তাণ্ডব দেখেছি তাতে খুব আঘাত পেয়েছি। আমরা যেখানে কাজ করছি সেই নবান্নেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমি সাধারণ মানুষকে আবেদন করব এখনই রিলিফ ক্যাম্প ছেড়ে কোথাও যাবেন না। সরকারি আধিকারিকদের পরামর্শ মেনে চলুন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১০ থেকে ১২ দিন সময় লাগবে। সেই সময়টা ধৈর্য ধরে থাকুন।”

    ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে মমতা বলেন, “আজ যেটা হল, সেটা ধ্বংস। করোনার জন্যে এমনিতেই রাজ্যের আয় বন্ধ। তারপর যা ক্ষতি হল তা হয়তো কয়েক হাজার কোটিতে যাবে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র পেতে ৩/৪দিন লাগবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

    কোলকাতার মানুষ গত ৫০ বছরে এমন ভয়াবহ ঝড় দেখেনি। শহরের অন্তত ৩০টি জায়গায় গাছ ভেঙে পড়েছে। শত শত গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়ায় যোগাযোগ কার্যত বন্ধ। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে গোটা শহর।পার্সটুডে