আবারো শিশু নির্যাতন:তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা,দুর্বল চার্জশিট

    0
    603

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,৬আগস্টঃ সিলেটে শেখ সামিউল আলম রাজন এবং খুলনার রাকিবুল ইসলাম রাকিবের পর এবার বরগুনার তালতলীতে ১১ বছরের এক শিশুকে চোখ উপড়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। জালসহ মাছ চুরির অভিযোগে তাকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়।

    উপজেলার ছোট আমখোলা গ্রামের এক মাছের ঘের থেকে মঙ্গলবার বিকেলে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রবিউল ইসলাম নামেও ওই শিশুটি ফরাজি বাড়ি দাখিল মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। তার বাবার নাম মো. দুলাল মৃধা। এ ঘটনায় রবিউলের বাবা তালতলী থানায় বুধবার হত্যা মামলা করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

    রবিউলের পরিবারের সদস্যরা জানান, সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঘর থেকে রবিউল বের হয়ে যায়। এরপর আর ফেরেনি। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওকে পাওয়া যায়নি। বিকেলে এক কিশোর স্থানীয় লকরার খালের মাছের ঘেরে রবিউলের লাশ পড়ে থাকার খবর দেয়। সেখানে গিয়ে রবিউলের লাশ খালে ভাসতে দেখা যায়। তার বাম চোখটি উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং থুতনির নিচে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

    পুলিশ ও রবিউলের স্বজনরা জানান, একই এলাকার দেলোয়ারের ছেলে মিরাজ (২৮) জাল পেতে নিয়মিত মাছ শিকার করে। কয়েকদিন আগে মিরাজ অভিযোগ করে, রবিউল ওই জাল থেকে মাছ চুরি করেছে। এ নিয়ে দু-তিন আগে মিরাজ তাদের (রবিউল) বাড়িতে এসে রবিউলকে হত্যার হুমকি দেয়। স্থানীয় খালেক সরদার জানান, মঙ্গলবার রাতেও মিরাজ বেশ কয়েকবার রবিউলকে খোঁজাখুঁজি করেছে। রবিউলের লাশ পাওয়ার পর মিরাজ আত্মগোপনের চেষ্টা করে।

    কান্নাজড়িত কণ্ঠে রবিউলের বাবা দুলাল মৃধা জানান, আমার ছেলে ফরাজি বাড়ি মাদ্রাসায় পড়ে। সে কারোর কিছু কিছু চুরি করে নাই। তার পরও দেলোয়ারের ছেলে মিরাজ রবিউলকে মেরে ফেলল। আমি এর বিচার চাই।

    দুলাল মৃধা আরও জানান, ওইদিনই সে (মিরাজ) বলেছিল, রবিউলকে হাতেনাতে ধরতে পারলে মেরে ফেলবে।

    নিহত রবিউলের মা মোর্শেদা বেগম অভিযোগ করে বলেন, মাত্র একশ’ টাকার একটা জালের জন্য আমার ছেলেকে হত্যা করেছে মিরাজ। আমি ওর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। ওরে দেখে সবাই যেন শিক্ষা নেয়। আর কোনোদিন কেউ যেন এরকম ঘৃণ্য-জঘন্য অপরাধ করতে সাহস না পায়।

    তালতলী থানার ওসি বাবুল আখতার জানান, প্রথমে নিহতের পরিবার অভিযোগ করেনি। বুধবার দুপুরে রবিউলের বাবা দুলাল মৃধা থানায় এসে হত্যা মামলা করেন। তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত মিরাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে খুনের কিছু আলামত জব্দ করেছি।

    বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) বিজয় বসাক জানান, হত্যার অভিযোগ পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আশা করি সবকিছু বেরিয়ে আসবে। সে অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

    বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার দুপুরে রবিউলের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লাশ বাড়িতে আনার পর তাকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

    শিশু হত্যা থামছেই না:

    এর আগে, বুধবার চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার তারাপুর গ্রামে কবিরাজি চিকিৎসার নামে বাবা এমরান হোসেন ও মা আমেনা বেগমের পিটুনিতে মারা গেছে তাদেরই শিশু সন্তান সুমাইয়া। জিনে ধরেছে বলে কবিরাজের পরামর্শে শিশুটিকে বেধড়ক পিটুনি দিলে রক্তক্ষরণে মারা যায় শিশুটি।

    সোমবার বিকেলে খুলনার টুটপাড়ায় রাকিব (১৩) নামের এক শিশুকে কমপ্রেসার মেশিন দিয়ে মলদ্বারে বাতাস ঢুকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কম্পাউন্ডে লাগেজের ভেতর থেকে আনুমানিক ৯ বছর বয়সের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। তার শরীরে ইস্ত্রির ছ্যাঁকাসহ ৫৭টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে শাহবাগ থানা পুলিশের করা সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ২৩ জুলাই মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধ চলাকালে গুলিতে মাতৃগর্ভেই গুলিবিদ্ধ হয় এক শিশু। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় সুরাইয়া। ১২ দিন বয়সী শিশুটি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। ৮ জুলাই চুরির অপবাদ দিয়ে সিলেটের শহরতলির কুমারগাঁওয়ে শিশু রাজনকে চার ঘণ্টা নির্যাতন করে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২৮ মিনিট ধরে এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও চিত্র ধারণ করে ফেসবুকে আফলোড করা হয়। একইভাবে ১৩ এপ্রিল রাজধানীর খিলক্ষেতের মস্তুল এলাকার ২০-২২ জনের একটি দল কবুতর চুরির অপবাদ দিয়ে ১৬ বছরের কিশোর নাজিমের ওপর বর্বর নির্যাতন করে। রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে বেধড়ক পেটানোর পর অচেতন অবস্থায় লাথি দিয়ে তাকে ফেলে দেয়া হয় বালু নদীতে। পানিতে রাজন ডুবে গেলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ঘাতকরা। মর্মান্তিক এই নির্যাতনের ভিডিও আপলোড ফেসবুকে দেয়া হয়।

    সাড়ে তিন বছরের নিহত ৭৭৭:

    গত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে ৭৭৭ শিশু নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও একটি ঘটনারও আজ পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি।  শিশু অধিকার ফোরামের হিসাবে দেখা গেছে, গত সাড়ে তিন বছরে ৭৭৭ শিশু নির্যাতনে মারা গেছে। এর মধ্যে চলতি বছরের সাত মাসে ১৯১ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। একই সময় হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে আরও ১১ জনকে। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৫০, ২০১৩ সালে ২১৮ ও ২০১২ সালে ২০৯। শিশু অধিকার ফোরামের রেকর্ডে আরও দেখা গেছে, মোট ৬১টি ক্যাটাগরিতে চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে মোট ২ হাজার ৮০১ শিশু নামামুখী নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে ৬ মাসে মোট ১৭৫ শিশু ও তরুণ।

    মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ২০১ জন শিশু হত্যা ও ৭০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিশু নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধির এই প্রবণতা ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে, যা সমাজের জন্য আশঙ্কাজনক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাজিক এবং পুলিশের নির্লিপ্ততা এই ধরনের সহিংস ঘটনা পুনরাবৃত্তির পথকে পরোক্ষভাবে সুগম করছে বলে সংগঠনটি মনে করছে।

    পুলিশ সদর দফতরের হিসাবেও দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধির চিত্র। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে মোট ১০ হাজার ৭৬৪টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড করেছে পুলিশ।

    শাস্তি না হওয়ায় বাড়ছে শিশু নির্যাতন:

    বিশেষজ্ঞরা বলেন, নৃশংস শিশু নির্যাতনের ঘটনার পর থানায় মামলা দায়েরে গড়িমসি, ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত ও তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, দুর্বল চার্জশিট, বিচারে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, বিচারে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে থাকে। ফলে স্থানীয়ভাবে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না। এ সুযোগে অপরাধী গা ঢাকা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক ও পুলিশ প্রশাসনের নির্লিপ্ততা সহিংসতার পুনরাবৃত্তির পথকেও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সুগম করছে বলে তারা মনে করেন।

    শিশুর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়া প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, শিশু নির্যাতনের জন্য রাষ্ট্র ও প্রশাসনের নীরব ভূমিকাও পরোক্ষভাবে দায়ী। এসব ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায়ই বারবার শিশু নির্যাতনের নৃশংস ঘটনা ঘটছে। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলগুলোরও কোনো ধরনের ভূমিকা দেখা যায়নি। তাই এসব নৃশংসতা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান তিনি।ইরনা