আদিবাসীরা কি নিজের ভূমি রক্ষা করতে শুধু জীবন দিবে ? 

    0
    266

    এই বছর ২০১৫ আলফ্রেড সরেন হত্যার ১৫ বছর অতিবাহিত হতে যাচ্ছে ১৮ আগষ্ট। আলফ্রেড সরেন তার জীবন দিয়েছিলেন ভূমিকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু সেই ভূমি রক্ষা করতে গিয়ে সেই ভূমির উপরই তাকে হত্যা করা হয়েছে । আলফ্রেড সরেন হত্যার আজও বিচার হয়নি । বিচার করার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রের । কিন্তু রাষ্ট্র আজও আলফ্রেড সরেনের হত্যাকারীদেও বিচার করতে পারেনি, এই হত্যার দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে । আজও আদিবাসীরা হত্যার স্বীকার হতে হচ্ছে নিজ ভূমি রক্ষার জন্য ।

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,১৭আগস্ট,সূভাষ চন্দ্র হেমব্রম: ১৮ আগস্ট বহুল আলোচিত জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ভীমপুর ইউনিয়ন শাখার সভাপতি আলফ্রেড সরেন হত্যার ১৫ বছর। আলফ্রেড সরেনের গ্রাম ভীমপুর, ইউনিয়ন ও ডাকঘর ভীমপুর, থানা মহাদেবপুর, জেলা নওগাঁ । নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী গ্রামে প্রায় ৪০০ বিঘা জমির দখল নিতে ভূমিদস্যু  ইউপি চেয়ারম্যান হাতেম আলী ও সীতেশ চন্দ্র ভট্রাচার্য ওরফে গদাই এর ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে প্রকাশ্যে দিবালোকে হামলা চালিয়ে আলফ্রেড সরেনকে  নির্মমভাবে হত্যা করে, নারীদের অশীলতাহানি ও শিশু বৃদ্ধ সহ অর্ধশতাধিক আদিবাসীদের কুপিয়ে মারাত্মক ভাবে জখম করে। ওই ঘটনায় সন্ত্রাসীরা ব্যাপক তান্ডব চালিয়ে গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়, বাড়িঘর ভাংচুর করে আদিবাসীদের সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যায় । ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা বর্বরোচিত ভাবে আদিবাসী শিশুদের পুকুরে নিক্ষেপ করেছিল কিন্তু দৈব চক্রে শিশুগুলো বেঁচে যায়। আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনার পরপরই সেখানে পুলিশের একটি  অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয় কিন্তু সেই ক্যম্প অল্পকিছুদিনের মধ্যেই গুটিয়ে নেওয়া হয়। অত্র গ্রামের আদিবাসীরা এখনোও নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছে। আদিবাসীদেরে একমাত্র সম্পদ চাষযোগ্য জমি না থাকায় অনাহারে দিনযাপন করছে। আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার বাদি ছোট বোন রেবেকা সরেন। মামলা হয় মহাদেবপুর থানায় হত্যা ও জন নিরাপত্তা আইনে । মামলায় মহাদেবপুর থানা পুলিশ তদন্ত শেষে ৯১ জনকে আসামী করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। পুলিশ কয়েকজন আসামীকে গ্রেফতার করে। মামলাটি নওগাঁ দায়রা জর্জ আদালতে সাক্ষি গ্রহণ শুরু হয় । ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষী গ্রহন সম্পন্ন হয়েছিল । আলফ্রেড সরেন হত্যার প্রধান দুই আসামী হাতেম আলী ও সীতেশ চন্দ্র ভট্রাচার্য ওরফে গদাই সহ ৬০ জনের অধিক আসামী জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে মামলাটি হাইকোর্টে তিন মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন এবং আদালত থেকে আসামীরা জামিনে বেরিয়ে আসে। সুপ্রিম কোটে রিটপিটিশন নম্বও ২৩২২/২০০১ এবং সিভিল পিটিশন নম্বও ৪২০/২০০৩ । আসামীরা বর্তমানে এলাকায় অবস্থান করছে । উচ্চ আদালতে মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আছে। আলফ্রেড সরেন এর মৃত্যুর এক বছর পর তার মাতা ঠাকুরানী সরেন মারা যান। গত কয়েক বছর পূর্বে তার বাবা গায়না সরেন এর মৃত্যু হয়। বর্তমানে আলফ্রেড সরেন এর স্ত্রী জোছনা সরেন রাজশাহী জেলার তানোর আমশো মথুরাপুওে কৃষিক্ষেত্রে দিন মজুরি করে দিন যাপন করছেন এবং তার একমাত্র কন্যা ঝর্ণা সরেন রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার তানোর কলেজে অধ্যয়নরত ।

     বর্তমানে মহাদেবপুর ভীমপুর আদিবাসী গ্রামে ১০ থেকে ১৫ টি পরিবারের বসবাস। উচ্চ আদালত থেকে সকল আসামী জামিনে মুক্তি পাওয়ায় এবং আদালতে আলফ্রেড সরেন এর মামলায় সকল কার্যক্রম স্থগিত থাকায় আসামীরা বিভিন্ন সময় আদিবাসীদের হুমকি-ধামকী দিচ্ছে। এর ফলে অত্র গ্রামে আদিবাসীরা আতংকের মধ্যে বসবাস করছে। অনেকে সেখান থেকে প্রানে বাঁচতে অন্যত্র চলে গেছে । বর্তমানে ভূমিদস্যুরা আদিবাসীদের জমি দখল করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না এই ভূমি দখল চক্রান্তকারী দল সব সময় নানাভাবে আদিবাসীদের উপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে । ফলে অনেক সময় আদিবাসীরা দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে। যারা দেশকে ভালবেসে নিজের ভূমিতে বসবাস করতে চেয়েছিল তাদেরকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, নির্যাতন করে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ের সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা ও নির্যাতনের কারনেও অনেক আদিবাসী নিজেদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ২০১৩ সালে ৩১ মে প্রকাশিত জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কর্তৃক একটি জরিপের প্রাথমিক ফলাফল থেকে জানা যায় মোট ১০ জেলায় (দিনাজপুর,নওগাঁ,বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর পঞ্চগড়, রংপুর, জয়পুরহাট ও ঠাকুরগাঁও) ২৪৩৫ টি আদিবাসী পরিবার ভূমি হারিয়েছে এবং ভূমি দখল প্রক্রিয়ায় আদিবাসী সম্প্রদায় মোট ৩৮২৭.২৮ একর জমি হারিয়েছে। বিভিন্ন কৌশলে আদিবাসীদের জমি বেদখল হচ্ছে। জরিপ অনুযায়ী সবচেয়ে বেশীসংখ্যক পরিবারের(৭৯৮) জমি বেদখল হয়েছে জমি জবরদখল করার মাধ্যমে (আদিবাসীদের ব্যবহৃত সম্পদ,শ্মশান, কবরস্থান, ধর্মীয় স্থাপন, পূজামন্ডপ)। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক পরিবারের(৫৪৯) জমি বেদখল হয়েছে দলিল জাল করার মাধ্যমে। জমির দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে সর্বোচ্চ পরিমান জমি ১১৯৯.৩ একর জমি দখল হয়েছে জমির দলিল জাল করার মাধ্যমে। এতে ৫৪৯ টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে । অন্যদিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমান জমি ১১৮৫.৭৬ একর দখল হয়েছে বন বিভাগ কর্তৃক। যার ফলে ৫২১ টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

     উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা শান্তিতে নেই। প্রতিনিয়ত ভূমি দস্যুরা ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের জোগসাজসে আদিবাসীদের জমি কেড়ে নিচ্ছে। উচ্ছেদ হচ্ছে নিজ বসত ভিটা থেকে এবং জাল ও জবরদখল হচ্ছে আদিবাসীদের জমি । এ থেকে ঘটছে হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, লুটপাট, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, মিথ্যা মামলা  প্রভৃতি। আদিবাসীরা  নিজেদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রন এর অধিকার, ভাষা-সংস্কৃতি ও জীবন যাপনের অধিকার, ভূমি ও সম্পদের উপর অধিকার নিয়ে আদিবাসীরা বাংলাদেশে বসবাস করতে চায়। আজ সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন সময়ের দাবি হয়ে দাড়িয়েছে । সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের মাধ্যমে সমতল অঞ্চলে যে সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের জমি হারিয়েছেন সেগুলো উদ্ধার ও রক্ষা করা সম্ভব।

     নওগাঁয় আদিবাসীদের উপর ঘটে যাওয়া কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মান্দায় চার জন আদিবাসী হত্যা, পতœীতলায় আদিবাসী শিশু মিঠুন খালকোকে গুলি করে হত্যা, নিয়ামতপুরে চঞ্চলা পাহা কে ধর্ষণের পরে নির্মম ভাবে হত্যা, ৩ বছরের আদিবাসী শিশু লিপি হাঁসদা ধর্ষণের শিকার হয়, বদলগাছিতে সাগরী উরাওকে ধর্ষণের পর হত্যা, ধামুরহাটে আদিবাসী কৃষক জাম¦ু চড়ে হত্যা, বুলো রাণী পাহান আফজাল হোসেন বাচ্চু দ¦ারা ধর্ষণ শিকার হয় তার জ্বালা সয়তে না পেরে আত্মহত্যা করে।

    ২০১১ সালে সেপ্টেম্বর  মাসে পোরশা জেলার ফুলবাড়ি বাঘডাঙ্গা গ্রামের ধানী জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে  মৃত গোরখা মুর্মুর ছেলে সুফল মুর্মু  ওরফে তোরা (৬০) এর হত্যার পর  গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে থানায় একটি মামলা রয়েছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নওগাঁ সদর উপজেলার কীর্তিপুর বাজার এলাকার একটি ধানের চাতালে দিনেশ ওরাঁও (৪০) নামের আদিবাসী এক দিনমুজুরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে । ২০১৪ সালে জুন মাসে সাপাহারে বাবুপুর গ্রামের মৃত রাম টপ্যর ছেলে রাতিয়া টপ্য (৪০) নামের এক আদিবাসী যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ ।

     উল্লেখিত ঘটনাগুলোতে মামলা করা হলেও আদিবাসীদের মামলা বলে মামলাগুলো সঠিক ভাবে তদন্ত করা হয় না, চার্জশীট প্রদান করা হয়না, যার ফলে মামলার সুরাহা হয়না, যার ফলে আদিবাসীদের ইপর হত্যা নির্যাতন দিন দিন বেড়েই চলেছে, আদিবাসীদের জন্য আইন বইযের মধ্যে লিখেত আকারে থেকে গিয়েছে তার কোন প্রয়োগ নেই ।