আজ ৬ ডিসেম্বর শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ-কুলাউড়া মুক্ত দিবস

    0
    327

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৬ডিসেম্বর: আজ ৬ ডিসেম্বর শনিবার মৌলভীবাজার জেলার ৩ টি  শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ,কুলাউড়া এলাকা মুক্ত দিবস। “১৯৭১” সালের এই দিনে এই তিনটি  এলাকা (যা বর্তমানে উপজেলা) হানাদারমুক্ত হয়।

    দীর্ঘ ৯ মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে সমগ্র দেশ শত্রুমুক্ত হলে ও তার পূর্বেই দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা ক্রমান্বয়ে শত্রুমুক্ত হতে থাকে । দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের অমানবিক হত্যা, জুলুম, রাহাজানি, নির্যাতন,ধর্ষণ সহ্য করে বাঙ্গালিরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার অধিকার ফিরে পায়। পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙ্গালিদের ন্যায্য দাবী আদায়ে বিদ্রোহী দীপ্তশিখায় সেদিন জ্বলে উঠতে বাধ্য হয়েছিলো।
    সারা দেশের মতো ওই ৩ টি এলাকায় কৃষক,সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র-যুবক, শ্রমিকসহ সবাই সাহসী ভূমিকা নিয়েছিল। ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর পূর্ব পাকিস্তানের চেহারা পাল্টে যায়। দেশজুড়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। ঠিক ওই সময়ে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রামে ওই এলাকা গুলোর দেশপ্রেমিক মুক্তিকামী সন্তানেরা হাতে তুলে নিয়েছিল মুক্তির অস্ত্র।

    এই দিনে লড়াকু মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ লড়াই করে হানাদার বাহিনীকে শ্রীমঙ্গল থেকে হটিয়ে শত্রুমুক্ত করেছিল। তবে এর আগে হানাদার বাহিনীর সাথে লড়াই করে নিহত হয়েছিলেন বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা। ৩০ এপ্রিলের পর থেকে হানাদার বাহিনী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রীমঙ্গলে হত্যা করেছিল অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য নীরপরাধ নারী পুরুষদের। ৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে সূচিত অসহযোগ আন্দোলন শ্রীমঙ্গলে তীব্র রূপ নেয়। অফিস-আদালতসহ শ্রীমঙ্গলের চা শিল্পে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। ২৩ মার্চ শ্রীমঙ্গল থানার পতাকা বেদিতে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে তোলা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। শ্রীমঙ্গল পৌরসভা অফিস সিলেট জেলার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত দুর্জয় সংগ্রামে প্রতিরোধ সংগ্রামীরা শ্রীমঙ্গলে স্বাধীন বাংলার পতাকা সমুন্নত রেখেছিলেন। ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এমএজি ওসমানী ও ব্রিগেডিয়ার পান্ডে দু’বার শ্রীমঙ্গলে আসেন। ২৪ এপ্রিল পাকবাহিনীর দু’টি বোমারু বিমান শ্রীমঙ্গলের আকাশে ৩০ মিনিট অবিরাম বোমা বর্ষণ করে।
    শ্রীমঙ্গলের প্রতিরোধ কর্মীদের কেউ আসারামবাড়ী সীমান্ত দিয়ে, কেউ ধলই সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ শেষে ঝাঁকে ঝাঁকে যোদ্ধারা দেশে আসেন দেশমাতৃকার আর তাদের সন্তানদের শত্র“মুক্ত করার দুর্জয় শপথ নিয়ে। যুদ্ধে নিহত উলে­¬খযোগ্য শহীদরা হলেন-হরমুজ আলী, মঈন উদ্দিন, আলতাফ মিয়া, রিক্সাচালক আনিছ, মুকিত লস্কর, পবন তাঁতীঁ, আবুল হোসেন, সমীর সোমসহ আরও অনেকেই। এদের সাথে প্রাণ হারান চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর কয়েক’শ শ্রমিক। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ চলাকালে শহর ও শহরতলীর কলেজ রোড ভাড়াউড়া চা বাগান, বিডিআর ক্যাম্প সংলগ্ন সাধুবাবার গাছতলা, সিন্দুরখান, সবুজবাগ ও পূর্বাশাসহ কয়েকটি স্থানকে বধ্যভূমিতে পরিণত করে শত শত নীরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিল দেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার বাহিনী। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই ও ভারতের সীমান্ত থেকে মুক্তিবাহিনী ক্রমশ ক্যাম্প অভিমুখে এগিয়ে আসার খবরে পাকবাহিনী ভীত হয়ে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে ৬ ডিসেম্বর ভোরে তারা পালিয়ে মৌলভীবাজারে আশ্রয় নেয়। একরকম বিনা যুদ্ধেই মুক্ত হয় শ্রীমঙ্গল শহর। উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ৬ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দেশে আসতে শুরু করেন এবং তারা মৌলভীবাজার অভিমুখে এগিয়ে গেলে ৮ ডিসেম্বর পাকবাহিনী মৌলভীবাজার থেকেও পালিয়ে যায়।

    মৌলভীবাজার জেলা থেকে কুলাউড়া ঢুকার পথে কাপুয়া ব্রিজের কাছে গতিরোধ করতে অকুতোভয় বীর সৈনিক মোজাহিদ সদস্য জয়চণ্ডী ইউনিয়নের আকরাম ওরফে আছকির মিয়া ও হাবিব উদ্দিন। পাকসেনা ও দু’দলের মধ্যে গুলি বিনিময় চলতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীন হন। এরা দু’জনই হলেন কুলাউড়া থানা এলাকার স্বাধীনতা বেদীমুলের প্রথম শহীদ। পাকসেনা ও এদেশের দোসরদের সহায়তায় নিধনযজ্ঞ অব্যাহত থাকে। ৫ এপ্রিল জয়চণ্ডী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাজাকার সহযোগে পাকসেনারা ২২ জন গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে এবং ২৪ মে। ১৪ জুন মীরবক্সপুর গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে একই গ্রামে গিয়ে নিধনযজ্ঞ চালায়।
    এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা যেসব স্থানে অপারেশন চালান এর মধ্যে উপজেলার দত্তগাঁও, চাতলাপুর চা বাগান, চাতলাপুর আলীনগর ফাঁড়ি, পাইকপাড়া, মনু রেলস্টেশন, পৃথিমপাশা, বরমচাল, জুড়ী বাজারসহ চা বাগান, ফুলতলা চা বাগান এলাকা, মনু রেলস্টেশন লাইন কর্মধা এলাকা উলে­খযোগ্য। নভেম্বরের শেষপ্রান্তে এবং ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ভারত ও বাংলাদেশ চুক্তি হওয়াতে যৌথ মিত্র বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লে যুদ্ধের গতি তীব্রভাবে বেড়ে যায়। থানার সবচেয়ে বড় ও সর্বশেষ অপারেশন হয় গাজীপুর চা বাগানে। উক্ত চা বাগানে যুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। নেতৃত্বে ছিলেন মেজর আব্দুল ওয়াহিদ মোগল। ব্যাপক পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এক ব্যাটালিয়ান সৈন্য বাগানে অবস্থান করছিল। অপরদিকে গাজীপুরের বিপরীতে চোঙ্গাবাড়ি। সেখানে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প ছিল। নভেম্বরের শেষদিকে গাজীপুর মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন এমএ মুমিত আসুক।
    সাগরনাল চা বাগানে প্রথম এসে অবস্থান নেন তারা। উক্ত স্থানে মিলিত হন ধর্মনগর থেকে আগত কর্ণেল হরদয়াল সিংহের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী ৬৭ রাজপুর রেজিমেন্টের একটি দল। তারাও বাগানে অবস্থান নেন। ৩০ নভেম্বর কাকুরা চা বাগানে অবস্থানকারী ৭৫ জন রাজাকার ও ৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য ধরা পড়ে। ১ ডিসেম্বর কাকুরা চা বাগান থেকে গাজীপুর চা বাগান এলাকার দিকে মিত্র বাহিনীরা অগ্রসর হলে পাকসেনাদের সাথে পাল্টা গুলি বর্ষণ চলতে থাকে। ২ ডিসেম্বর রাতে তুমুল যুদ্ধ হয়। ৩ ডিসেম্বর ৪/৫ গোর্খা রেজিমেন্ট কর্ণেল হারকিলের নেতৃত্বে একটি দল সাহায্যে এগিয়ে আসে। পেছনে ৯৯ মাইল্টেল ব্রিগেডের আর্টিলারী সহায়তায় রাতেও প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। তবুও গাজীপুর চা বাগান এলাকা দখলমুক্ত সম্ভব না হওয়াতে ৪ ডিসেম্বর যুদ্ধের পরিকল্পনা বদলে ফেলা হয়। পিছন দিক থেকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেন হারকিল।
    পরিকল্পনানুযায়ী এমএ মুমিত আসুক ও মোহনলাল সোম পিছনে আসার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাত ১২টায় সম্মিলিত বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। শেষদিকে লস্করপুর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী এ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উক্ত যুদ্ধে ২৫০ জন পাক সৈন্য প্রাণ হারান। জীবিতরা সবাই পলায়নের চেষ্টা করেন। ৫ডিসেম্বর গাজীপুর চা বাগান এলাকা মুক্ত হয়। ওইদিনই সন্ধ্যার দিকে সম্মিলিত বাহিনী কুলাউড়ায় পৌঁছে। এ রাতেই সব পাকিস্তানি সৈন্য ব্রাহ্মণবাজারের দিকে সড়কপথে কুলাউড়া ত্যাগ করে। এভাবেই ৬ ডিসেম্বর কুলাউড়া শত্র“মুক্ত হয়। থানায় লাল সবুজ স্বাধীনতার পতাকা আকাশে উড়তে থাকে।
    সারা বাংলায় অসংখ্য মুক্তযোদ্ধাদের ন্যায় কুলাউড়া থানায় বিভিন্ন স্থান থেকে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাসহ ৪৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে পাওয়া এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। উপজেলা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংরক্ষণসহ বধ্যভূমি সংরক্ষণ ব্যবস্থা আজও করা হয়নি। স্বাধীনতার ৪১ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে কুলাউড়ায় নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ। এটি জেলার মধ্যে এখন ইতিহাসের সাক্ষী। থানার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই ভিক্ষুক, রিক্সাচালকসহ বিভিন্নভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার সুশীল চন্দ্র দে ও সাবেক কমাণ্ডার আতাউর রহমান আতা সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, সেই দিনের পৈশাচিকতা এখনও স্মৃতিতে ভয়াল রূপ নিয়ে ফিরে আসে প্রতি বছর। তারা বলেন, ৭ মে থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকসেনা ও তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র, যুবক ও কৃষকসহ প্রায় ৪৫০ জনকে হত্যা করে। এ ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজমুল হাসান জানান, কুলাউড়ায় ঠিক কতগুলো বধ্যভূমি আছে তার সঠিক হিসাব আমার কাছে নেই। অচিরেই সেগুলো চিহিৃত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
    কমলগঞ্জ মুক্ত দিবস
    একই দিন স্বাধীনতার উষালগ্নে এই দিনে সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। এই দিনে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে বিপর্যস্ত হয়ে কমলগঞ্জের দখলদারিত্ব ছেড়ে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। এই দিনে কমলগঞ্জের মুক্তিপাগল বাঙালি উড়িয়ে দেয় স্বাধীনতার পতাকা। এই দিনটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার সৈয়দ মখলিছুর রহমান জানান, প্রকৃতপক্ষে ৬ ডিসেম্বরই কমলগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে কমলগঞ্জ উপজেলায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কমলগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই এখানে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুগত ৬০ জনের একটি দল তৈরি করে উপজেলার শমশেরনগর বিমান ঘাটিতে ট্রেনিং এর কাজ চলতে থাকে। ১০ মার্চ ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলের নেতৃত্বে একটি দল পাকসেনা মৌলভীবাজারে অবস্থান নেয়। ২৩ মার্চ পাকিস্থান দিবসে তৎকালীন ছাত্রনেতা নারায়ণ ও আব্দুর রহিম পাকিস্থানি পতাকা পুড়ানোর দায়ে গ্রেফতার হন। পরে অবশ্য জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। কমলগঞ্জ উপজেলা ছিল বামপন্থীদের সুদৃঢ় ঘাঁটি। তারা মৌলানা ভাসানী ও হক তোহায়া গ্র“পের সাথে সংশ্লি¬¬ষ্ট ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনালগ্নে নকশালপন্থীদের নির্মূল করার অজুহাতে মেজর খালেদ মোশাররফকে কমলগঞ্জে পাঠানো হয়। তিনি ছিলেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা।
    ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হলে তিনি পাকবাহিনীর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে জনতার কাতারে সামিল হন। ঢাকায় এ গণহত্যার প্রতিবাদে ২৬ মার্চ কমলগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে স্বতঃস্ফ‚র্ত মিছিল বের হয়। পাকসেনারা সেই মিছিলের ওপর গুলি চালালে সিরাজুল ইসলাম নামের এক বৃদ্ধ শহীদ হন। এ হত্যাকাণ্ডে উপজেলাবাসীর মনে জ্বলে ওঠে প্রতিশোধের আগুন। স্থানীয় বাঙালি ইপিআর ও পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরাও একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম পরিষদের সাথে। ২৮ মার্চ শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়ির সমস্ত অস্ত্র উঠিয়ে আনা হয়। মালগাড়ির বগি দিয়ে ভানুগাছ-শমশেরনগর-মৌলভীবাজার রাস্তায় বেরিকেড দেওয়া হয়। ২৯ মার্চ পাকবাহিনী খবর পেয়ে আবারও কমলগঞ্জে আসে। সন্ধ্যায় পাকসেনারা ভানুগাছ থেকে শমশেরনগরে এলে মুক্তিসেনাদের অতর্কিত আক্রমণে ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলসহ ৯ জন পাকসেনা নিহত হয়।
    স্বাধীনতার উষালগ্নের এই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধে প্রচুর অস্ত্র গোলাবারুদসহ পাকসেনাদের ২টি গাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। সর্বপ্রথম এই সশস্ত্র যুদ্ধে বিজয় লাভের পরদিনই কমলগঞ্জে মুক্তিপাগল জনতার সমাবেশে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা পরিষদ। এরপর থেকেই নিয়মিত চলতে থাকে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। ২৮ মার্চের পর পাকবাহিনী জল, স্থল ও আকাশপথে কমলগঞ্জে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মোকাবিলায় সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছে।
    এ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩টি ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাত্রখোলা, ধলাই ও ভানুগাছের যুদ্ধ। ন্যাপ নেতা মফিজ আলী, ক্যাপ্টেন মোজাফফর আহমদ, আওয়ামীলীগ নেতা এমএ গফুর, ময়না মিয়া, ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান প্রমুখের সাহসী নেতৃত্বে কমলগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সাথে লড়েছেন। এখানকার বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন বঙ্গবীর এমএজি ওসমানী, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, বিগ্রেডিয়ার আমিন আহম্মদ ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মতো দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা।
    এ উপজেলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে শহীদ হয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান, ল্যান্সনায়েক জিল্লুর রহমান, সিপাহী মিজানুর রহমান, সিপাহী আব্দুর রশিদ, সিপাহী শাহাজাহান মিয়াসহ নাম না জানা অনেকেই।
    ৪ ডিসেম্বরে ভানুগাছ এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধের পর কমলগঞ্জ সদর থেকে পাক হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কমলগঞ্জের মাটিতে উড়ে স্বাধীনতার পতাকা। ৪ ডিসেম্বর তারিখে কমলগঞ্জের ভানুগাছ বাজারের নিকটবর্তী ধলাই ব্রীজে সম্মুখযুদ্ধে ৩ জন ও কমলগঞ্জ থানার সামনে জাতীয় পতাকা উড়ানোর সময় অপর একজন অস্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্য হানাদারবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। এরা হলেন-কুমিল্লা মুরাদনগরের কালাপাইনা গ্রামের সিপাহী মিজানুর রহমান, দেবীদ্বারের বড়শালঘর গ্রামের সিপাহী আব্দুর রশিদ, পাবনা শাহাদাৎপুরের দারগাপাড়া গ্রামের ল্যান্সনায়েক জিল্লুর রহমান, চট্টগ্রামের নিরশ্বরাইয়ের মগাদিয়া গ্রামের সিপাহী শাহাজান মিয়া। দেশের জন্য সম্মুখযুদ্ধে নিজের জীবন উৎসর্গকারী এই ৪ বীর যোদ্ধাকে ৫ ডিসেম্বর সকালে পার্শ্ববর্তী আলীনগর ইউনিয়নের পশ্চিম কামুদপুরে দাফন করা হয়। পরদিন ৬ ডিসেম্বর কমলগঞ্জ মুক্ত হয়েছিল বলে জানান সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার ও বর্তমান ডেপুটি কমাণ্ডার সৈয়দ মখলিছুর রহমান।

    এমন সময় মুক্তিযোদ্ধারা দেশে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেই অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠনকারী ও শত শত মানুষকে হত্যাকারী রাজাকার আলবদর ও তাদের দোসরদের শাস্তির কাজে। কিন্তু কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামীলীগের কয়েক নেতার বাঁধার মুখে ছাড়া পেয়ে যায় অনেক দেশের অনেক রাজাকার।