আজ সোমবার ৩০ নভেম্বর কমলগঞ্জে মণিপুরী রাসপূর্ণিমা

    0
    506

    শাব্বির এলাহী,কমলগঞ্জ: আজ (৩০ নভেম্বর) মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরের অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বৃহত্তর সিলেটের ক্ষদ্র নৃ-তাত্ত্বিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যতম বিশ্বনন্দিত সাংস্কৃতিক ধারক মণিপুরী সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব রাসপূর্ণিমা । বৈশ্বিক মহামারির করোনার করাল আক্রমণের শ্কংায় এবার উৎসব বিহীন থাকছে ভরা কার্ত্তিকের রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলায় মণিপুরী ঐতিহ্যের সুমহান ধারায় ১৭৮তম রাসপূর্ণিমা।ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ থাকবে নান্দনিক এ মহাযজ্ঞ। বংশ পরম্পরায় নান্দনিকতার পূজারী মণিপুরীদের প্রাচীনতম সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব রাসলীলা। প্রতি বছর কার্ত্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপিত হয় বলে একে রাস পূর্ণিমা বা পূর্ণিমারাসও বলা হয়। প্রেমের পূণ্যবাঁধনে বিকশিত হবার দিন রাস পূর্ণিমা। চিরাচরিত এ উৎসবের মধ্য দিয়ে সব বয়সী মণিপুরীরা একত্রিত হয় সংস্কৃতি লালনে এবং দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে বৈচিত্রময় ও সমৃদ্ধশালী করার অঙ্গীকারে।
    নাগর কানাইয়া লালমে
    কুঞ্জ কালিলমে আওত হে
    বংশী মূরলী বাজাও হে
    রাধা রাধা আওত হে
    ব্রজবুলী এসব পদাবলী কন্ঠে এ প্রজন্মের রাধাকৃষ্ণ, বৃন্দা ও গোপীগণের অপূর্ব সুরের আবেশে কমলগঞ্জের প্রকৃতি মাতাল হলেও মানুষের পদভারে মুখরিত হবে না।। রাসলীলা ১৮৪২ সাল থেকে মাধবপুর জোড়ামন্ডপে প্রতি কার্ত্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে খুবই ভাবগাম্ভীর্যের সাথে উদযাপিত হয়ে আসছে। যদিও একই উপজেলার তেতইগাঁও সানাঠাকুর মন্ডপে ১৯৮৬ সাল থেকে এ উৎসব উদযাপিত হচ্ছে। শ্রীমদ্ভাগবতের দশমস্কন্ধের রাস প ধ্যায়ের উপর ভিত্তি করে রাস কেন্দ্রিক মণিপুরী সংস্কৃতি ও প্রথা অনুযায়ী প্রাচীন শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরে পূজা অর্চ্চনার মধ্য দিয়ে রাস পূর্ণিমা অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। রাসলগ্নে রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহকে রাসচক্রে প্রদক্ষিণ করিয়ে মন্দিরে স্থাপন করা হয়। দুপুর থেকে শুরু হয় রাখাল নৃত্য। হাতে বাঁশি কপালে চন্দ্রের তিলক, মাথায় ময়ুরপালকের চূড়া ও ধুতি পরিহিত কিশোরেরা ঘুঙুর পায়ে-
    রায় ধবলীরে কালি কেওলী
    হিংগুলি জিংগুলি সুরভীরে…………. রায় ধবলী।
    গাইতে গাইতে পরিবেশন করবে মনোরম রাখালনৃত্য। নৃত্যপ্রধান এ উৎসবে রাখাল নাচ রাধাকৃষ্ণ অভিসার থাবলচঙবা ছাড়াও মধ্যরাতে চাঁদের মায়াবী আলোতে শুরু হবে মাধুর্য্যরসে আস্বাদিত রাধা ও সখীগণের মুখ্যরাস বা মহারাসলীলা। প্রথমেই পরিবেশিত হয় রাসধারীদের অপূর্ব মৃদঙ্গ নৃত্য তারপরে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ হাতে রাধিকারূপে মণিপুরী তরুনীরা মে আবির্ভূত হলে উপস্থিত ভক্তরা উলুধ্বনি তুলে স্বাগত জানাবে। গোপীনৃত্য, কৃষ্ণলীলা, মণিপুরী বন্দনা কলস নৃত্য চলবে রাতভর সুবর্ণ র্ককন পরিহিতা সুন্দরী গোপিনীদের নুপূরের সিঞ্জনে। রাসমেলার আয়োজকরা জানিয়েছেন, মহারাসলীলাল মূল উপস্থাপনা শুরু হবে দুপুর থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য’ দিয়ে। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালকবেলাকে উপস্থাপন করা হবে।

    এতে থাকবে কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বিবরণ। গোধূলি পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য। রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। এই রাসনৃত্য ভোর (ব্রাহ্ম মুহুর্ত) পর্যন্ত চলবে। এই রাসনৃত্যে গোপিনীদের সাথে কৃষ্ণের মধুরলীলাই কথা, গানে ও সুরে ফুটিয়ে তুলবেন শিল্পীরা।মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ‘আমাদের প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ। এখন পুরো এলাকায় উৎসবের আমেজ। নতুন কাপড়চোপড় কেনা হয়েছে। আমাদের কাছে হেমন্তকাল মানেই রাস-পূর্ণিমা, রাস উৎসব।কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশেকুল হক ও কমলগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আরিফুর রহমান বলেন, আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তার জন্য দুই জায়গাতেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনুষ্টানে নিরাপত্তায় পুলিশের তিন স্তরের ব্যবস্থা গ্রহন করেছে।

    তবে এবছর করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যবিাধ মেনে সীমিত পরিসরে ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে মণিপুরী রাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে। মেলার অনুমতি দেয়া হয়নি। লোকসমাগম সীমিত করা হবে।রাসলীলায় মণিপুরী নৃত্য শুধু কমলগঞ্জের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। ১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা।

    কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস আগ থেকেই চলছে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। মণিপুরী সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারী কিশোরদের রাস লীলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেয়ার ধুম পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তাবৎ বাড়িতে রাসধারী ও রাসলীলার উস্তাদ এনে শিক্ষা দেয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। আনুমানিক ৪০/৫০ জন কিংবা ততোধিক সংখ্যার কিশোরী এ রাস লীলায় অংশগ্রহণ করে থাকে।