আজ লাখাই উপজেলার কৃষ্ণপুর গণহত্যা দিবস

    0
    544
    “১৯৭১ সালে দেশব্যাপী নারকীয় গনহত্যা চললে পার্শ্ববর্তী কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণভয়ে আশ্রয় নেয় প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই গ্রামটিতে”
    জেলা প্রতিনিধি,হবিগঞ্জঃ  আজ ১৮ ই সেপ্টেম্বর, হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার কৃষ্ণপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় ১২৭ জন ব্যক্তিকে ব্রাশ-ফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ।
    লাখাই উপজেলার ১ নং লাখাই ইউনিয়নের অন্তর্গত হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রাম কৃষ্ণপুর। ইউনিয়নের অন্যান্য গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন একটি এলাকা যেখানে শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে এবং বর্ষায় নৌকায় চলাচল করতে হয়। ১৯৭১ সালে দেশব্যাপী নারকীয় গনহত্যা চললে পার্শ্ববর্তী কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণভয়ে আশ্রয় নেয় প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই গ্রামটিতে।
    কিন্তু এই খবর স্হানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে পৌঁছে যায় অষ্টগ্রামে অবস্থিত পাক আর্মি ক্যাম্পে। ১৮ ই সেপ্টেম্বর ভোর ৪ টা বা ৫ টায় অমাবস্যার অন্ধকারের ন্যায় কালো ছায়া নেমে আসে ঐ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটিতে । চারদিক থেকে রাজাকাররা ঘিরে ফেলে গ্রামটিকে ।
    কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম ক্যাম্প থেকে ২ টি স্পিডবোটে করে ১০-১৫ জন পাক সৈন্য সেখানে আসে। তাদের সাথে যোগ দেয় স্হানীয় রাজাকার কমান্ডার মোড়াকরি গ্রামের লিয়াকত আলী, বাদশা মিয়া, কিশোরগঞ্জের আলবদর আমিনুল ইসলাম ওরফে রজব আলী (আমি আলবদর বলছি বইয়ের লেখক) লাল খাঁ, নাসিরনগর থানাধীন ফান্দাউকের আহাদ মিয়া, সন্তোষপুরের মোর্শেদ কামাল ওরফে শিশু মিয়াসহ প্রায় ৪০-৫০ জন রাজাকার, আলবদর। তাদের সহযোগিতায় নিরীহ ১৩১ জন হিন্দু ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে স্হানীয় কমলাময়ী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠপ্রাঙ্গনে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
    তন্মধ্যে হরিদাস রায়, প্রমোদ রায়, নবদ্বীপ রায় ও মন্টু রায় বুলেটের আঘাতে জর্জরিত হয়েও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তবে তারা সারাজীবনের জন্য বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েন। গ্রামে আক্রমনের খবর পেয়ে যারা পুকুরে কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন তারাই প্রানে বেঁচে ছিলেন।
    নারীদের উপর নেমে এসেছিল অকথ্য নির্যাতন। রাজাকার আলবদররা পুরো গ্রামে লুটপাটের তান্ডব চালায়। পরে রাজাকারদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে পুরো গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা । বিকেল ৪ টা পর্যন্ত চলা এ তান্ডব পুরো গ্রামটিকে কার্যত শ্মশানে রূপান্তর করে।
    একসঙ্গে ১২৭ জন লোকের সৎকারের ব্যবস্থা না করতে পেরে পাশাপাশি রাজাকাররা তাদের বেঁচে থাকার সংবাদ জানতে পারে এই শঙ্কায় বলভদ্র নদীতে মৃতদেহ ভাসিয়ে দেয় লোকজন। কমলাময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪৫ জন শহিদের নাম সম্বলিত স্মৃতিফলক আজও সেই ভয়াল স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয় ।
    বর্তমানে এখানে সরকারিভাবে বধ্যভূমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তিনজন শহীদের ম্যূরাল ও স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। ২০১০ সালে সালের ৪ ঠা মার্চ বেঁচে যাওয়া হরিদাস রায় হবিগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে রাজাকার লিয়াকত আলীসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলা দায়ের করেন। ২০১০ সালের ১২ ই আগস্ট মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রথম মামলা হিসেবে সিলেট বিভাগ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক গৃহীত হয়।
    মামলার রায়ে রাজাকার লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে আনিত ৭ টি অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজা হলে ও বর্তমানে সে দেশের বাইরে পালিয়ে রয়েছে। শহিদ পরিবারের সন্তানসহ সকল জনগনের দাবি তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হোক । তাহলেই লাখাই তথা কৃষ্ণপুরবাসী কলঙ্কমুক্ত হবে এবং শহিদদের আত্মা শান্তি পাবে।